Header Ads

বাংলার ঐতিহ্য কুমারটুলির ঢাকেশ্বরী মন্দির


কলকাতার কুমোরটুলি পাড়ার দুর্গাচরণ স্ট্রিটে রয়েছে শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মায়ের মন্দির। কুমোরটুলির বনমালী সরকার স্ট্রিটে ঢুকে ডান দিক বরাবর খানিকটা এগোলেই লাল রঙের এই মন্দিরের দেখা মেলে। মন্দিরের দেওয়ালের গায়ে লেখা রয়েছে, 'শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দির''। বিশাল বর্গাকার দালানের একপ্রান্তে শ্বেত পাথর দিয়ে বাঁধানো এক ঘরে বিরাজ করছেন অষ্টধাতুর ঢাকেশ্বরী। দেবী মূর্তির উচ্চতা দেড় ফুটের মতো। কাত্যায়নী মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা রূপেই অবস্থান করছেন। মূর্তির দুটো চালি রয়েছে, পিছনের চালিটা ঢাকা থাকে সামনের রুপোর চালিতে। দেবীর পাশেই লক্ষ্মী ও সরস্বতী এবং নীচে কার্তিক ও গণেশ। দেবীর বাহন পৌরাণিক সিংহ। বাহন রূপে পশুরাজ সিংহ দন্ডায়মান যার ওপর দাঁড়িয়ে দেবী মহিষাসুরকে বধ করেছেন। দেবীর সামনের হাত দুটো বড়, পিছনের আটটা হাত কিছুটা ছোট। মূর্তির একপাশে রাম ও হনুমানের মূর্তি আর অন্যপাশে মটিতে রাখা একটা ধাতুর সিংহাসনে রয়েছে লক্ষ্মীর ছবি ও নারায়ণ শিলা। শিবলিঙ্গও রয়েছে। এই মূর্তি ঢাকা শহরের দেবী, সময়ের সরনী বেয়ে মূর্তিটি এসে পড়েছে কলকাতায়।


এগারো শতকের একেবারে শেষ লগ্নে বাংলায় সেন বংশের রাজত্বকাল আরম্ভ হয়েছিল। তাঁরা ছিলেন ব্রহ্মক্ষত্রিয়। সেনেদের আদি নিবাস ছিল দাক্ষিণাত্যের কর্নাট অঞ্চলে। সেনরা ঠিক কবে বাংলায় আসেন সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। যদিও একাধিক কিংবদন্তি রয়েছে। সেন রাজাদের রাজত্ব বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে উত্তর ভারতের কনৌজ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পাল বংশের শাসনকালে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের রমরমা ছিল। সেন বংশের আমলে হিন্দু ধর্মের দাপট বাড়তে শুরু করে। 

প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী জানা যায়, সেন বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা বিজয় সেনের স্ত্রী স্নানের জন্য লাঙ্গলবন্দ গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় তিনি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, সেই পরবর্তীর বল্লাল সেন। পরবর্তী কালে সেন বংশের সিংহাসনের আরোহণের পর তিনি বাংলাদেশের ঢাকায় ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দির তৈরি করে শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মাতার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। অন্য মতে, স্বপ্নাদেশ পেয়ে জঙ্গলের মধ্যে আচ্ছাদিত অবস্থায় মায়ের মূর্তি উদ্ধার করেন রাজা বল্লাল সেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, মূর্তিটি আচ্ছাদিত বা ঢাকা থাকায় মূর্তির নামকরণ করা হয় ঢাকেশ্বরী। 

আরেকটি মতে, অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন অবস্থায় বল্লাল সেনের মাকে কোনও কারণে এক উপবনে নির্বাসন দেওয়া হয়। সেই সময়ে তিনি দেবী ঢাকেশ্বরীর পুজো করেন। ওই বনেই বল্লাল সেনের জন্ম হয়। বনের মধ্যে জন্ম হয়েছিল বলে, তাঁর নাম রাখা হয় বনলাল বা বল্লাল। রাজা হওয়ার পর, নিজের জন্মস্থানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি সেই জঙ্গলের গাছ কাটিয়ে ঢাকেশ্বরীর মন্দির তৈরি করে দেন। যদিও এক দল ঐতিহাসিকের মতে, এই বল্লাল সেন গৌড়ের রাজা নন,  আরাকান রাজ শ্রীসুধর্মর ভাই মঙ্গতরায়ও নাকি বল্লাল সেন নামে পরিচিত ছিলেন। আরকান থেকে বিতাড়িত হয়ে সেই বল্লাল সেন ঢাকায় এসেছিলেন।

আবার অন্য এক কিংবদন্তি অনুসারে জাহাঙ্গীর বাংলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম কেদায় রায়কে পরাজিত করে তাঁর গৃহদেবী শিলাময়ীকে ঢাকায় নিয়ে চলে আসেন। সেখানকার শিল্পীদের দিয়ে আরও একটা মূর্তি তৈরি করতে নির্দেশ দেন। শিল্পীরা আসল মূর্তির সামনে বসে হুবহু একই রকম একটি মূর্তি তৈরি করেন এবং নতুন তৈরি মূর্তিটা আসল মূর্তির সঙ্গে বদলে মানসিংহকে দিয়ে দেন। মানসিংহ নতুন মূর্তি ঢাকায় রেখে, আসল মূর্তিটা জয়পুরে নিয়ে চলে যান।

ঢাকেশ্বরী মূর্তি দীর্ঘকাল ঢাকায় ছিল। দেশভাগের সময় ১৯৪৮ সালে গোপনে এক বিশেষ বিমানে ঢাকেশ্বরী দেবীর আসল মূর্তি কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। দেবীকে যেভাবে নিরাবরণ ও নিরাভরণ অবস্থায় কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল তার ছবিও মন্দিরে সংরক্ষিত আছে। মনে করা হয় দেবী এখানে আদি পরা মহাশক্তির একটি রূপ। এই বিগ্রহটি প্রায় ৮০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন। তারপর প্রথম দুই বছর হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রিটে দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরির বাড়িতেই দেবী ঢাকেশ্বরীর পুজো করা হয়েছিল। ১৯৫০-এ দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরী কুমোরটুলি অঞ্চলে ঢাকেশ্বরী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিত্য সেবার জন্য কিছু দেবোত্তর সম্পত্তি দানও করেন। ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ, কলকাতার কুমারটুলিতে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দেবীর পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সেখানেই পূজিতা হয়ে আসছেন। 

আবার কেউ কেউ বলেন, মানসিংহ নাকি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে আজমগড়ের এক তিওয়ারি পরিবারকে সেবায়েত নিযুক্ত করেছিলেন। সেই পরিবারের বংশধরেদের উদ্যোগেই মূর্তি কলকাতায় আসে এবং তাঁরাই এখানে সেবায়েত নিযুক্ত হন। দেশভাগ পরবর্তী দাঙ্গার সময় আক্রমণ ও লুঠ থেকে দেবীকে রক্ষা করতে ঢাকার মূল বিগ্রহটিকে গোপনে এবং দ্রুততার সঙ্গে ১৯৪৮-এ কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন রাজেন্দ্রকিশোর তিওয়ারি মতান্তরে প্রহ্লাদকিশোর তিওয়ারি এবং হরিহর চক্রবর্তী। শোভাবাজারের ব্যবসায়ী দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরি মহাশয়ের বাড়ির গুদামঘরে বিগ্রহকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। 

ঢাকেশ্বরী দেবীর পুজো পদ্ধতি কিন্তু বাংলায় প্রচলিত দুর্গাপুজোর পদ্ধতির মতো নয়। শারদীয় দুর্গাপুজোর সময় এখানে নবরাত্রিক বিধি মেনে পুজো হয়। মহালয়ার পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদ থেকেই দেবীর পুজো শুরু হয়ে যায়। চলে দশমী পর্যন্ত। শুক্ল প্রতিপদে কল্পারম্ভ হয় ও অখণ্ড দীপ প্রজ্জ্বলিত হয়। মন্দিরে মা দুর্গার নিত্যপুজো হয়। আবার বাঙালি মতে সপ্তমী থেকে দশমী বিশেষ পুজোও হয়। বৃহনান্দীকরণ দুর্গাপুজো পদ্ধতি অনুয়ায়ী পুজো চলে। সপ্তমিতে দেবীকে ভোগ দেওয়া হয় পঞ্চব্যাঞ্জন ও চাটনি। অষ্টমীতে দেওয়া হয় পোলাও, খিচুড়ি, সবজি, পায়েস ও চাটনি। সন্ধি পুজোয় চালকুমড়োর বলি হয়। মহানবমীতে পোলাও ও লুচি দেওয়া হয়।

গর্ভগৃহে একটু উঁচু বেদীর ওপর মায়ের মূর্তি অবস্থিত। মূর্তির সামনে তিনটি বড় বড় ঘট থাকে। তিনটি ঘটের মধ্যে মাঝেরটি দেবীর ঘট, আর ডানদিকের ঘটটি দেবী চণ্ডীর ঘট, আর বাঁদিকের ঘটটি গণেশের ঘট। ঘটের ওপর ডাব গামছার বদলে অখণ্ড দীপ বসানো হয়। মঙ্গল চিহ্ন মতো করে ঘটের গায়ে মাটি দিয়ে যব লাগানো হয়। দেবীর বেদীমূলে লেখা, 'ঢাকেশ্বরী জগন্মাতঃ ত্বং খলু ভক্ত বৎসলা। স্বস্থানাৎ স্বাগতা চাত্র স্বলীলয়া স্থিরা ভব।।' অর্থাৎ - হে দেবী জগন্মাতা ঢাকেশ্বরী তুমি পরম ভক্তবৎসলা। আজ থেকে এই তোমার স্বস্থান, তোমার স্বস্থানে তোমায় স্বাগত জানাই মা। ঢাকায় যে লীলায় তুমি ছিলে আজ থেকে এই খানে তুমি স্বরূপে স্বমহিমায় স্থিরভাবে বাস করে নিজ লীলা বিস্তার কর।' ভক্তদের বিশ্বাস দেবী অত্যন্ত জাগ্রত। প্রার্থনা করলে, তিনি তা পূরণ করেন।

লেখায়- প্রাবন্ধিক সৌভিক রাজ


No comments