বিন্ধ্য থেকে কাশ্মীর বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিলেন বাংলার বীর সম্রাট দেবপাল
আমরা ইতিহাসের পাতায় অনেক রাজা-রাণীদের জীবনী ও তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য ও রাজ্যকে বহিরাগত শত্রুদের থেকে রক্ষার জন্য যুদ্ধের কথা পড়ে থাকি। তাঁদের যুদ্ধ, সংগ্রাম ও কৌশল অনেকটাই রাজ্যের মানুষজনকে বাঁচানোর জন্যই ছিল। তাঁদের বীরগাথা ও প্রজাপালনের কথা যুগ যুগ ধরে মানুষ স্মরণ করে এসেছে। আমরা তেমনি একজন বাংলার মহারাজাকে নিয়ে আলোচনা করব যাঁর নাম দেবপাল আর তিনি প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত পালবংশীয় নৃপতি। তাঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত পালরাজা ধর্মপাল। দেবপাল সুদীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। তাঁর রাজত্বকাল ছিল ৮১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ— বলা যায় প্রায় চল্লিশ বছর। তিনি ছিলেন তাঁর পিতা ধর্মপালের মতোই পরাক্রমশালী। তিনি ছিলেন পাল বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা।
দেবপালের তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে তাঁর রাজত্ব দক্ষিণের বিন্ধ্য পর্বত থেকে উত্তরের কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মুঙ্গের থেকে যে দেবপালের তাম্রলিপি পাওয়া যায় তা থেকে জানা যায় যে, তাঁর সাম্রাজ্য হিমালয় থেকে রামেশ্বর সেতুবন্ধ পর্যন্ত বিস্তারলাভ করেছিল। আবার তাঁর মন্ত্রী কেদার মিশ্রের পুত্র গুরব মিশ্র তাঁর লিপিতে লিখে গেছেন যে "দেবপাল হলেন হিমালয় হইতে বিন্ধ্য পর্বত এবং পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রের মধ্যবর্তী অঞ্চলের প্রভু।" তিনি আরও উল্লেখ করে গেছেন যে, "দেবপালই শক্তিশালী হুন জাতির গর্ব খর্ব করেছিলেন।" সুদূর আরব থেকে আসা পরিব্রাজক সুলেমান দেবপালকে বর্ণনা করেছেন এক বিশেষ শক্তিশালী রাজা হিসেবে। তাঁর বর্ণনায় জানা যায় যে, দেবপালের বিরাট সৈন্যবাহিনী ছিল।
রাজাসনে বসেই প্রথমে তিনি ওড়িশা ও অসমের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। জানা যায় যে, উৎকলরাজ বা ওড়িশারাজ জয়পাল তাঁর কাছে যুদ্ধে হেরে নতি স্বীকার করেছিলেন। উৎকলরাজকে পরাজিত করার পর তিনি উত্তর ভারতের শক্তিশালী প্রতিহাররাজ ভোজকে-ও যুদ্ধে হারান।
প্রাগজ্যোতিষপুরে বা অধুনা গুয়াহাটি তথা অসমের রাজা প্রলম্ভ দেবপালের কাছে যুদ্ধে হেরে নতি স্বীকার করেছিলেন। জানা যায় যে, অসমরাজ বিনা যুদ্ধে তাঁর কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। গুর্জররাজ বা গুজরাটের রাজাও দেবপালের কাছে নতি স্বীকার করেছিলেন। তিনি হিমালয় অঞ্চলের কম্বোজ রাজকে পরাজিত করে হিমালয় অঞ্চল জয় করেন। ভারতবর্ষের পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিমদিক জয় করে তিনি দক্ষিণদিকে অগ্রসর হন। দক্ষিণের রাষ্ট্রকূট রাজা প্রথম অমোঘবর্ষ দেবপালের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন। তারপরে সেখানকার পাণ্ড্য রাজ্য জয় করে এই বাঙালি শাসক সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করেছিলেন। বলাই যায় যে, দেবপালের আমলে বীর বাঙালি সেনা ব্রহ্মপুত্র থেকে সিন্ধুনদ, হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল পুরো দাঁপিয়ে বেড়িয়েছিল। অনেকে মহারাজ হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যকে উত্তর ভারতের শেষ হিন্দু সাম্রাজ্য বলে মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের চেয়েও বিশাল বিস্তার ও বেশিকাল ধরে স্থায়ী ছিল এই পাল সাম্রাজ্য। অবশ্যই মহারাজ দেবপালের জন্যে।
মহারাজ দেবপাল একজন দাতা হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। যবদ্বীপ, সুমাত্রা ও মালয় উপদ্বীপের শৈলেন্দ্র বংশের রাজা বালপুত্রদেব নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিহার স্থাপনের জন্যে দেবপালের কাছে পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলেন। যা দেবপাল দিয়েও ছিলেন। বলা হয় যে, মহারাজ দেবপালের পৃষ্ঠপোষকতায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি আন্তর্জাতিক মহলেও প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল।
এই বীর পাল-মহারাজা দেবপালকে স্মরণের সাথে এই প্রার্থনা করি তাঁর মতো তেজেই যেন বাঙালি জাতি আবার ভরপুর হয়ে ওঠে।
প্রতিবেদন- ইন্দ্রনীল মজুমদার
তথ্যসূত্র- বীরবাঙ্গালী- প্রণয় রায়; শঙ্খনাদ প্রকাশন, ইতিহাস অভিধান (ভারত)- যোগনাথ মুখোপাধ্যায়; এম.সি.সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রাঃ লিঃ।
Post a Comment