কেবল গঙ্গাজল বেচেই বিত্তবান হয়েছিলেন বাঙালি ব্যবসায়ী বৈষ্ণবচরণ শেঠ
একসময় বাঙালিরা বণিক জাতি হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত ছিল। বর্তমান সময়ে বাঙালি যেমন শুধু চাকরির পিছনে ছুটছে সেকেলে তেমন বাঙালিরা ব্যবসার পিছনে ছুটতো। জাহাজ ব্যবসা থেকে রেল ব্যবসা সবেতেই বাঙালি ব্যবসায়ীরা ছিল সর্বেসর্বা। সেসব এখন অতীত৷ তবে এখনও যে বাঙালিরা ব্যবসা করছে না একথাও অবশ্য বললে ভুল হবে। যাইহোক, সেকেলে বাঙালিরা ব্যবসা-বাণিজ্যে এতোটাই সমৃদ্ধশালী ছিল যে কেউ সামান্য গঙ্গাজল বেচেও কোটিপতি হয়েছিল। হ্যাঁ, গল্প হলেও সত্যি, এক বাঙালি ব্যবসায়ী গঙ্গাজল বেচে কোটিপতি হয়েছিলেন। কে এই মহাপুরুষ?
বৈষ্ণব চরণ শেঠ নামটা এ প্রজন্মের কোনো বাঙালিই শোনেননি৷ এই মহান মানুষটিই কেবল গঙ্গাজল বিক্রি করে বিত্তবান হয়েছিলেন। তিনি যেভাবে গঙ্গাজল ব্যবসা করে বিত্তবান হন তার পিছনে এক লম্বা ইতিহাস রয়েছে। যা জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে প্রাক পলাশী যুগে। ইংরেজরা যখন কলকাতায় এসে ঘাঁটি গাড়ল, তখন তাদের মালপত্র বাজারে বিক্রির জন্য স্থানীয় বেনিয়াদের প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই কাজে যোগ দিয়ে রাতারাতি বেশ কয়েকজন বাঙালি ব্যক্তি বিত্তবান হয়ে ওঠেন।
সেকেলের নামকরা ব্যবসায়ী জনার্দন শেঠ। যিনি ব্রিটিশদের ব্যবসা সংক্রান্ত দালালির কাজ করতেন। এই জনার্দন শেঠের পুত্র হলেন বৈষ্ণব চরণ শেঠ। যার কেরামতিতে কিছুটা হলেও সেকালের বাঙালি ব্যবসায়ীরা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সামান্য গঙ্গাজল বেচে কোটিপতি হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
সনাতনী ধর্মমতে নানান কাজে গঙ্গাজল লাগে। বিবাহ-অনুষ্ঠান থেকে শ্রাদ্ধ ও পূজা-অর্চণার কাজে বেশি করে গঙ্গাজল ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশরা ভারত দখল করার পর আদালতে বাদী-বিবাদী হিন্দুদের শপথ নেওয়ার ক্ষেত্রেও গঙ্গাজল ব্যবহার করা হতো। কিন্তু গঙ্গাজল গোটা ভারতে পাওয়া যাবে না। আর্যাবর্ত ছাড়া এই গঙ্গাজল এদেশে সহজলভ্য ছিল না। দাক্ষিণাত্যে তো কোনোভাবেই নয়। সুতরাং, চাহিদামত ভারতের যেখানে যেখানে গঙ্গা নেই সেখানে গঙ্গাজল পাঠাতে পারলে যে দু'পয়সা ঝুলিতে আসতে পারে সেটা পাকা পাটোয়ারি বুদ্ধিতে অনুভব করেছিলেন বৈষ্ণব চরণ। তবে এটাও ঠিক যে তখন এমন ব্যবসা যে আর কেউ করত না, তা নয়। তবু তিনি একটা ফাটকা খেলেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন এক্ষেত্রে সফল হতে গেলে সুনাম অর্জন করতে হবে প্রথমে। আর তারপরই তাঁর জোগানো গঙ্গাজল সহজেই একটা 'ব্র্যান্ড নেম' হয়ে উঠবে।
বৈষ্ণব চরণ গঙ্গাজল ব্যবসা আরম্ভ করলেন। গঙ্গাজল ব্যবসাতেও নানান ভেজাল লক্ষ্য করা যেত। ঠিক এখানেই বৈষ্ণব চরণের সফলতা, কারণ তিনি একদম খাঁটি গঙ্গাজল বিক্রি করতেন। তাঁর গঙ্গাজলের কদর ক্রমশ বাড়তে থাকে। রাজ-রাজা, জমিদাররা হাঁড়ির পর হাঁড়ি গঙ্গাজল কিনে নিয়ে যেতে থাকে তাঁর কাছ থেকে। দূর-দূরান্ত থেকেও গঙ্গাজলের বরাত পেতে থাকেন তিনি। দেশের নানান প্রান্তের মানুষের কাছে তাঁর গঙ্গাজল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শোনা যায়, দাক্ষিণাত্যের তেলেঙ্গানার রাজাও নাকি বৈষ্ণব চরণের কাছ থেকে গঙ্গাজল কিনতেন। গঙ্গাজলের হাঁড়ির গায়ে তাঁর নামাঙ্কিত শিলমোহর লক্ষ্য করা যেত।
গঙ্গাজল ব্যবসা করেই জোড়াসাঁকো অঞ্চলে প্রাসাদের মতো এক বাড়ি নির্মাণ করেন। তাঁর সম্পত্তি এতোটাই ফুলে ফেঁপে উঠেছিল যে তিনি ইংরেজদের কাছ থেকে জোড়াসাঁকো অঞ্চলের সিংহভাগ কিনে নিয়েছিলেন।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment