বাঙালি আজ ভুলতে বসেছে 'গণিত সম্রাট' যাদব চক্রবর্তীকে
আজ যাঁদের সত্তর, আশি বা নব্বই-এর কোটায় বয়স বা তারও বেশি, তাঁরা অনেকেই 'পাটিগণিত' বা 'Arithmetic' বইটির সাথে পরিচিত। শুধু এঁরাই নন, যাঁদের বয়স এমনকি চল্লিশ, পঞ্চাশ বা ষাটের কোটায় তাঁরাও পরিচিত। বর্তমানে বিদ্যা ব্যবসা হয়ে যাওয়ার ফলে এবং গতানুগতি পড়াশোনার দয়ায় বিভিন্ন বিষয়ের ভালো ভালো বই আর ছাত্র-সমাজ লাভ করতে পারছে না। বলতে দুঃখ হয় শিক্ষক সমাজের এক বড়ো অংশই গণিতের অনেক ভালো ভালো বইয়ের নামই জানেন না এমনকি বাংলার অনেক নামকরা গণিতবিদদের কথাই জানেন না, এমনকি নামই শোনেননি অনেকেই। এরকম এক বিস্মৃতপ্রায় বাংলার বিখ্যাত গণিতবিদের নাম 'যাদব চক্রবর্তী'।
সে বহুকাল আগের কথা, দেশ স্বাধীনতারও নব্বই বছর আগের। তখন অখণ্ড বঙ্গভূমি ছিল। ওই অখণ্ড বাংলার পাবনা (বর্তমান সিরাজগঞ্জ) জেলা শহর থেকে মাত্র সাত-আট মাইল দক্ষিণে কামারখন্দ উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে ১৮৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন যাদব চক্রবর্তী। তাঁর পিতার নাম কৃষ্ণচন্দ্র চক্রবর্তী ও মাতার নাম দুর্গা সুন্দরী দেবী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ছিলেন যাদব চক্রবর্তী। তাঁর পিতা ছিলেন একজন পুরোহিত। তাঁদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। দুঃখের বিষয় যাদব চক্রবর্তীর বাল্যবয়সে তাঁর পিতা মারা যান।
যাদব চক্রবর্তীর লেখাপড়া শুরু হয় তেঁতুলিয়া কালিয়া বাবুদেব পাঠশালায়। এরপরে ভর্তি হন কাওয়াকোলা স্কুলে। তিনি অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তখনকার মধ্যবৃত্তি পরীক্ষায় গোটা রাজশাহী বিভাগে প্রথম হয়ে মাসিক চার টাকা হারে বৃত্তি পেয়েছিলেন। ওই স্কুলের পরে পড়েন এম.ই. স্কুলে (বর্তমান বি.এল. সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়)। ১৮৭৬ সালে তিনি এন্ট্রাস (এখনকার মাধ্যমিক) পাস করেন প্রথম বিভাগে, বৃত্তি পান মাসিক ১৫ টাকা। এরপর গণিতে কৃতিত্বের সাথে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। জানা যায় যে, এম.এ. পড়ার খরচা চালানোর জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রকালীনই সেন্ট পল'স্ ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যা পড়াতেন। যাইহোক, মাস্টার্স করার পর তিনি কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন।
অধ্যাপনার সময়েই পাটিগণিতের এক গুণগত বইয়ের অভাব বোধ করেন আর সেই অভাবের তাগিদেই লেখেন গণিতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই 'Arithmetic', যা প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালে। তাঁর গাণিতিক পারদর্শীতার জন্য আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়-এর প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমেদ তাঁকে পাটিগণিতের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেন এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি একটা আবাস (বলা যায় বাংলো) ভাড়া করে দিয়েছিলেন। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময়েই খুব অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হওয়া 'Arithmetic' বইটি বাংলা, উর্দু ও হিন্দি সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়। বলাবাহুল্য জনপ্রিয় এই বইটি অসমীয়া, মারাঠি, নেপালী প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয়। বইটি পরে তাম্রলিপি প্রকাশনী পুনঃপ্রকাশ করে। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালেই ১৯১২ সালে তার 'Algebra' বা 'বীজগণিত' বইটি প্রকাশিত হয়। এই বইও অনেক জনপ্রিয় হয়। একটা সময় ছিল যখন শুধু বাংলায় নয় সারা ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর রচিত পাটিগণিত বা বীজগণিত বই ছিল অবশ্যপাঠ্য। 'পাটিগণিত' বইটি লিখেছিলেন সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির জন্য। অথচ গণিতের মূল বিষয় যেমন সংখ্যা তত্ত্ব (Number theory) থেকে শুরু করে সবই পাওয়া যাবে ওই বইয়ে। আর আছে থিওরি বা তত্ত্ব, উদাহরণ আর নানা অঙ্কে ভরা অনুশীলনী। বর্তমান বাজারে নিঃসন্দেহে এই বই অনন্যতার দাবি রাখে।
উপমহাদেশ ছাড়িয়ে তাঁর বই ইউরোপের নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও পাঠ্যপুস্তক হিসেবে স্থান পেয়েছিল। শোনা যায় যে সিরাজগঞ্জ জ্ঞানদায়িনী হাইস্কুল, ভিক্টোরিয়া কিংবা রেলওয়ে স্কুলের ছাত্ররা অঙ্ক পরীক্ষার আগে তাঁর বাড়ির মাটি সম্মান বা প্রণাম করে পরীক্ষা দিতে যেত যদি অঙ্কের ভিত কাটে বা পরীক্ষা ভালো হয়। তাঁর বাড়ির মাটিও তাঁর বইয়ের মতো এতটাই পবিত্র ছিল।
শুধু ভারতবাসীরাই নয় তাঁকে ভক্তিভোরে সম্মান করতেন লাল-মুখো সাহেবরা। ব্রিটিশ সরকার তাঁর গণিতের অবদানের জন্য 'গণিত সম্রাট' উপাধি দেয়। গণিতের মতো বিশাল এক সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন বলেই তিনি গণিতের সম্রাট। পরবর্তীতে তাঁর জ্যামিতি নিয়ে বইও প্রকাশিত হয়। বিখ্যাত গণিতজ্ঞ জিয়াউদ্দিন আহমেদ ছিলেন তাঁর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
১৯০১ সালে সিরাজগঞ্জের ধানবান্ধিতে এক পাকা বাড়ি নির্মাণ করেন। তাঁর সন্তানদের তিনি এখানে রেখেই লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯১৬ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পর এখানেই বসবাস করতে শুরু করেন তিনি। তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তাটিও তাঁর নামানুকরণে জে সি রোড বা যাদব চক্রবর্তী রোড রাখা হয়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই যে, তাঁর বাড়িটির বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ও দখলদারদের দৌরাত্বের ফলে তেমনকিছু আর অবশিষ্ট নেই।
গণিত শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি সিরাজগঞ্জ মিউনিসিপ্যালের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সিরাজগঞ্জ নাট্যভবন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা বর্তমানে পৌর ভাসানী মিলনায়তন নামে পরিচিত। তাঁর গ্রাম তেঁতুলিয়ায় একটি পাকা মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন।
দেশ বিভাগের অনেক আগেই যাদববাবু কলকাতায় চলে আসেন এবং এখানে নিজের বাসভবনে ১৯২০ সালের ২৬ শে নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বর্তমান যুগে তিনি বিস্তৃতপ্রায় অথচ গণিত জগতে তাঁর স্থান ও অবদান আজও সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করার মতো। যতই দেশ ও বিদেশের গাণিতিক বই থাকুক না কেন বারবার একটাই প্রশ্ন জাগে মনে আর তা হল গণিত জগতে যাদব চক্রবর্তী-র স্থান কেউ কি নিতে পারবে?
প্রতিবেদন- ইন্দ্রনীল মজুমদার
Post a Comment