ব্রিটেনে লিবারেল দলের হয়ে পার্লামেন্টের নির্বাচনে লড়েছিলেন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
সালটা ১৮৬২। পরাধীন ভারতবর্ষ। ব্রিটিশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে গোটা দেশ। শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি, ব্যবসা সমস্ত ক্ষেত্রেই বঞ্চনার শিকার হতে থাকেন দেশের মানুষ। তার মাঝেও পিছিয়ে থাকেনি বাঙালি সমাজ। এই সময় বাঙালির তরুণ প্রজন্মের একাংশের মনে ব্রিটেনে ব্যারিস্টারি পড়ার খিদে জন্মায়। একের পর এক বাঙালি তরুণ ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ব্রিটেন পাড়ি দিতে থাকেন। ১৮৫৯ সাল থেকে যে সকল বাঙালিরা ব্রিটেনে লেখাপড়া শিখতে যান, তাঁরা যান প্রধানত আইন অধ্যয়ন করার জন্য। কেউ কেউ আবার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যেও গিয়েছিলেন৷ কেউ কেউ গিয়েছেন উভয় উদ্দেশ্যেই।
ব্রিটেনে পড়তে গিয়ে বহু বাঙালি ব্রিটেনের সক্রিয় রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। মাইকেলের পরে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেত যান তিনি৷ কলকাতার বন্দর এলাকা খিদিরপুরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনি জন্মেছিলেন। তাঁর বেড়ে ওঠাও ওখানেই। তাঁর বাবা অ্যাটর্নি হলেও তাঁদের বাড়ির আর্থিক অবস্থা মোটেও সুখকর ছিল না। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে রুস্তামজী জামশেদজী জিজিভাই বৃত্তি লাভ করেন বলেই তাঁর পক্ষে বিলেত যাওয়া সম্ভবপর হয়। যদিও তাঁর পিতা এবং আত্মীয়রা তাঁর বিলেত যাওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি গোপনে তাঁর বাবার বন্ধু ককেরেল স্মিথের সঙ্গে দেখা করেন। এই ককেরেল স্মিথই তাঁর বিলেত যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন। তারপর ১৮৬৪ সালের গ্রীষ্মে তিনি কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে খিদিরপুর বন্দরে জাহাজে চড়েন৷ বিলেতে পৌঁছে প্রথমেই তিনি তাঁর বাবাকে একটি চিঠি লিখেন৷ তাঁর স্ত্রী হেমাঙ্গিনী তখন ছিলেন তাঁর পিতৃগৃহে। তিনি যে তাঁর স্বামীকে আটকে রাখতে পারেননি, সে জন্যে আত্মীয়রা তাঁকেই দোষারোপ করেন।
বিলেতে যাওয়ার পরেই উমেশচন্দ্র আইন পড়ার জন্য মিডল টেম্পলে ভর্তি হন। তিন বছর পরে ১৮৬৭ সালের ১১ ই জুন তারিখে তিনি উত্তীর্ণ হন ব্যারিস্টার হিসেবে। তাঁর বিলেত প্রীতি ছিল অসাধারণ। একই সঙ্গে তিনি আবার ছিলেন দেশপ্রেমিক। আর রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ ছিল গোড়া থেকেই। লন্ডনে থাকার সময়ে ১৮৬৫ সালে তিনি দাদাভাই নওরোজিকে নিয়ে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সমিতি গঠন করেন এবং তার সম্পাদক হন। প্রায় দু দশক ধরে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি হয়েছিলেন তিনি।
উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিচার বুদ্ধি ও তর্ক শক্তি ছিল অসাধারণ। তিনি মোট চারবার স্ট্যান্ডিং কাউন্সিলের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৮৬৮ সালে তিনি ফিরে এসে হাইকোর্টের ব্যারিস্টার অ্যাট ল' স্যার চার্লস পলের পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েক বছরের মধ্যে হাইকোর্টের ব্যারিস্টারদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। ১৮৭১ সালে তিনি 'হিন্দু উইলস অ্যাক্ট ১৮৭০' সম্পাদনা করেন। তিনি স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল হিসেবে প্রথম ভারতীয় ছিলেন এবং সেই ক্ষমতাবলে তিনি যথাক্রমে ১৮৮২, ১৮৮৩, ১৮৮৪, ১৮৮৬-৮৭ সালে তিনি চারবার এই দায়িত্ব সামলেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের হলে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর হয়ে লড়েছিলেন। রাজনীতিতে তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল সেই সাথে ছিল স্বদেশ সেবায় প্রবল উৎসাহ।
১৮৯২ সালে এলাহাবাদে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের সময় জাতীয় কংগ্রেসের অষ্টম অধিবেশনে তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য ভারতের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে এই অবস্থানকে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক কাউন্সিলেরও সদস্য ছিলেন। ১৮৯৮ সালে তিনি ইংল্যান্ডের লিবারেল দলের প্রার্থী হিসেবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অফ কমন্সের নির্বাচনেও লড়াই করেছিলেন।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
তথ্যসূত্র- সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান, কালাপানির হাতছানি বিলেতে বাঙালির ইতিহাস : গোলাম মুরশিদ
Post a Comment