বাঙালি বিজ্ঞানী হীরালাল চৌধুরীর যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলো এশিয়ার মৎস্য বিপ্লব ঘটিয়েছিল
মাছের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক চিরকালের। নদীমাতৃক বাংলায় মাছ চিরকাল বাঙালির প্রিয় খাদ্যের মধ্যে একটি। একটা সময় ছিল যখন বাংলার ধান জমি, নদী-নালা, পুকুর-বাঁধ মাছে পরিপূর্ণ ছিল। বর্তমানে কীটনাশকের ব্যবহার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জলাশয় হ্রাস পাওয়ায় প্রাকৃতিক মাছ সেভাবে পাওয়ার সুযোগ কমছে।
সারা এশিয়াতেই প্রাকৃতিক ভাবে মাছ পাওয়ার সুযোগ কমেছে যার ফলে কৃত্রিম ভাবে মাছ চাষের গুরুত্ব দিন দিন বেড়েছে। কিন্তু এই কৃত্রিম ভাবে মৎস্য প্রজননের আবিষ্কার হয়েছে এই বাংলা থেকেই আমরা এ ব্যাপারে অনেকেই হয়তো জানিনা।
বাঙালি বিজ্ঞানী হীরালাল চৌধুরীকে বলা হয় প্রনোদিত প্রজনন বা ইনডিউসড ব্রিডিং বা হাইপোফাইজেশনের জনক। সমগ্র এশিয়াতে ব্লু রিভোলিউশন বা নীল বিপ্লবের জন্য হীরালাল চৌধুরীর ভূমিকা ছিল অন্যতম। পুকুরের জলাশয়ের স্তর বিন্যাসে বিভিন্ন মাছ চাষ করে মাছের ফলন বৃদ্ধি করার ব্যাপারে ওনার গবেষণা মৎস্য বিজ্ঞানের আমুল পরিবর্তনে সাহায্য করেছে। ওনার আবিষ্কৃত রুই, সাইপ্রিনাস, মৃগেল ও কাতলা মাছের হাইপোফাইজেশন টেকনিক ভারত, চীন, বাংলাদেশ, মায়ানমার ও দক্ষিণ এশিয়ার মাছ চাষকে অন্য মাত্রা দেয়।
১৯৬৭ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত তিনি ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (ফাও) এবং ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলাপম্যান্ট প্রোগ্রামের মৎস্য সংক্রান্ত উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত তিনি সাউথ-ইস্ট এশিয়ান ফিশারিস ডেভেলাপম্যান্ট সেন্টারের ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। সমগ্র এশিয়াতে মৎস্য বিপ্লব ঘটিয়ে অপুষ্টি দূরীকরণে ওনার অবদান অনস্বীকার্য।
ওনার আবিষ্কৃত ব্রিডিং টেকনিক একের পর এক দেশ যেমন মায়ানমার, ফিজি, সুদান, লাওস, মালয়েশিয়া, ফিলিপ্পিন, নাইজেরিয়া ব্যবহার করে সাফল্য লাভ করে ও তাদের মাছের ফলন বৃদ্ধি পায়।
হীরালাল চৌধুরী ১৯২১ সালে সিলেটের কুবাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে স্নাতক এবং বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর লাভ করেন। তারপর তিনি আমেরিকার আওবার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এস. ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ও সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফিসারিজ এডুকেশন থেকে ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। মৎস্যবিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য সারা বিশ্ব থেকে তিনি জিতেছেন একের পর এক পুরষ্কার। ১৯৬০ সালে চন্দ্রকলা হোরা মেমোরিয়াল থেকে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি লাভ করেন গামা সিগমা ডেল্টা অ্যাওয়ার্ড। আওবার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন গোল্ডেন কি অ্যাওয়ার্ড। ১৯৯৪ তে জিতেছেন ওয়ার্ল্ড অ্যাকোয়াকালচার অ্যাওয়ার্ড। এছাড়াও জিতেছেন রফি আহমেদ কিদওয়াই অ্যাওয়ার্ড।
তিনি ব্যারাকপুরে ইটভাটার ধারে লক্ষ্য করেন যে জোয়ারের জলে পেটফোলা মাছ টিপে দিলেই ডিম্বাকৃতি স্বচ্ছ ডিম বেরিয়ে আসছে এবং তা কয়েক ঘণ্টা জলে রাখলেই প্রাণের সঞ্চার ঘটছে। এ থেকেই তিনি প্রনোদিত প্রজননের ব্যাপারে চিন্তা করেন। এই ঘটনার পর প্রায় ৯ বছর গবেষণা করে তিনি ১৯৫৭ সালের ১০ ই জুলাই তিনি প্রনোদিত প্রজননে সফল হন। এই ঘটনাটি ছিল সারা বিশ্বে প্রথমবার। যে কারণে জাপানের বিখ্যাত মৎস্য বিজ্ঞানী ড. কে কুরোনুমা হীরালালকে প্রনোদিত প্রজননের জনক বলে অভিহিত করেন। পুকুরের নিবিড় মিশ্রচাষেরও জনক তিনি। ওনার এই আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দিতে ১০ ই জুলাই কে ভারত সরকার জাতীয় মৎস্যচাষী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় বাঙালি হীরালাল চৌধুরীকে মনে রাখেনি।
প্রতিবেদন- অমিত দে
Post a Comment