স্বপ্ন সাহিত্যিক হওয়া,পানের দোকানে বসেই একডজন উপন্যাস লিখেছেন পিন্টু পোহান
পানের দোকান চালিয়ে সংসার চলে পিন্টু পোহান নামে এক ব্যক্তির। পান বিক্রেতা হলেও তাঁর স্বপ্ন একজন সাহিত্যিক হওয়া। বেহালার রাজা রামমোহন রোডের মদনমোহন তলা বাজারে তিন ফুট বাই তিন ফুটের একটি টিনের গুমটির মধ্যে রয়েছে তাঁর পানের দোকান। সেখানে বসে তিনি ইতিমধ্যেই লিখে ফেলেছেন এগারোখানা উপন্যাস, দুশোখানা গল্প, ও শখানেক প্রবন্ধ। শৈশব থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল একজন বড় লেখক হওয়া৷ যে স্বপ্ন একটু একটু করে আজকে পূরণ হচ্ছে।
মদনমোহন তলা বাজার দিনরাত লোকজনের চিৎকার আর পায়চারিতে গমগম করতে থাকে। একটু বেলা বাড়লেই দোকানে দোকানে ক্রেতা-বিক্রেতার চিৎকার-চেঁচামেচি, পথের ধারে গাড়িঘোড়ার হর্ণ ও ইঞ্জিনের শব্দে কান ঝালাফালা হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায়৷ বিকট শব্দে গোটা বাজারজুড়ে যেন অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়৷ তার মাঝেও একমনে তিনি দীর্ঘ ২২ বছর ধরে সাহিত্য রচনা করে চলেছেন।
প্রথম প্রথম বাজারের লোকেরা তাঁকে দেখে হাসাহাসি করতেন। কেউ কেউ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, "ওনার লেখা পাতে দেবার মতো তো"? এভাবে তাঁকে নিয়ে অনেকে ব্যঙ্গ করলেও তিনি যে কত উচ্চমানের লেখক তা তাঁর লেখনী পড়লেই বোঝা যায়৷ পিন্টু পোহান তাঁর গল্পে মানুষ কে মানুষ বলে গণ্য করে বন্ধু প্রেম অটুট রাখেন প্রতি মুহূর্তে। রাজমিস্ত্রী থেকে মাছ বিক্রেতা, সব্জি বিক্রেতা, মুদি দোকানদার, বই বিক্রেতা, সাফাই কর্মী কাউকে নিম্নচোখে দেখেন না তিনি। এটা যে কতটা সত্যি সেটা তাঁর গল্প ও উপন্যাসগুলি পড়লেই বোঝা যায়।
১৯৭৮ সালে কলকাতার এক নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পিন্টু পোহান৷ জয়শ্রী হরিচরণ বিদ্যাপীঠে আরম্ভ হয় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি। এরপর তিনি বড়িশা শশীভূষণ জনকল্যাণ বিদ্যাপীঠ থেকে মাধ্যমিক ও সোদপুর শ্রীমন্ত বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁর পরিবারে দারিদ্র্যতা ছিল নিত্যসঙ্গী। যে কারণে উচ্চমাধ্যমিকের পর তিনি কলেজে ভর্তি হলেও খুব বেশিদিন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। জীবন-জীবিকার তাগিদে দিনের পর দিন পথ হাতড়ে পড়াশোনা ত্যাগ করে অবশেষে ভগ্ন হৃদয়ে বেহালার মদনমোহন তলা বাজারের ফুটপাতে এক অস্থায়ী পানের দোকানে খুলে বসলেন তিনি।
তাঁর ক্রমশ মনে হতে থাকে হয়তো সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্নটা তাঁর ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তিনি হাল ছাড়লেন না। তিনি দোকানের ভেতরেই নানারকম বইপড়া আরম্ভ করেন। কিন্তু নতুন নতুন বই কিনে তাঁর বই পড়ার সামর্থ্য ছিল না, সেজন্য একটি স্থানীয় গ্রন্থাগারের সহায়তায় বই সংগ্রহ করতে থাকেন তিনি। বই পড়ার জন্য পেয়ে যান দু'একটি কলোয়ারের দোকান, যেখানে কেজি দরে বই পাওয়া যায়৷ সেগুলোর সাহায্য সম্বল করেই এগিয়ে চলে তাঁর সাহিত্য সাধনা। তবে সমস্যা দেখা যায় অন্য জায়গায়। তিনি দোকানদারি করতে গিয়ে বইপড়া থেকে লেখালেখি কোনোটারই সুযোগ পাচ্ছেন না৷ তাহলে কীভাবে তিনি সাহিত্যিক হবেন? দোকান বন্ধ করে তো আর সাহিত্য লেখার কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। শেষমেশ লেখালেখি ও পড়াশোনার সহজ উপায় বের করলেন তিনি। দোকানের খদ্দেরদের যাতায়াতের ফাঁকে ফাঁকে লিখতে থাকেন তিনি৷
২০০০ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকেন৷ যেগুলো বাংলার প্রথম সারির পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। শুকতারার গল্প প্রতিযোগিতায় ভালো গল্প লেখার জন্য তাঁর নামও কখনও কখনও প্রকাশিত হতো৷ আনন্দমেলা, সানন্দা, দেশ, নবকল্লোল, কৃত্তিবাস, শিলাদিত্যের মতো পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে তাঁর গল্প। শুধুমাত্র লিখে ও একটি পানের দোকানের ওপর ভরসা করে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না বুঝতে পেরে তিনি বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন এই দোকানে বসেই৷ বর্তমানে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার। পারুলমাসির ছাগলছানা, নোটন নোটন পায়রাগুলি, ইলিশখেকো ভূত ও কচুরিপানার ভেলা।
কখনও যদি আপনি বেহালার মদনমোহন তলায় যান, দেখতে পাবেন, ফুটপাতের এক ছোট্ট দোকানে রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে দোকানদারির পাশাপাশি মানুষের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ উপেক্ষা করে সাহিত্য সাধনা করে চলেছেন এক সাহিত্য সাধক পিন্টু পোহান।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment