Header Ads

বাংলার সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ন্যাড়াপোড়া


"আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরিবোল।" - এই শ্লোকটির সঙ্গে বাঙালিরা একসময় পরিচিত থাকলেও বর্তমান প্রজন্ম পরিচিত নয় এই শ্লোকের সাথে। বাংলার অর্ধেক বাচ্চারা ন্যাড়াপোড়া শব্দটাই এখন ভুলতে বসেছে। ন্যাড়াপোড়া কী? কেন ন্যাড়া পোড়ানো হয়? যা সম্পর্কে এখনকার কোনো বাঙালির প্রায় ধারণা নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ বাঙালি অভিভাবক-অভিভাবিকার উদাসীনতার জন্য বর্তমান প্রজন্মের বাঙালি ছেলেমেয়েরা বাংলার সংস্কৃতি থেকে লক্ষযোজন দূরে সরে যাচ্ছে। 


আজ থেকে বিশ তিরিশ বছর আগেও বাঙালির দোল খেলার আনন্দ দ্বিগুণ ছিল। দোল খেলার আগের দিন থেকেই বাঙালির মনে বসন্ত উৎসবের দোলা লেগে যেত। দোলের আগের রাতে খোলা মাঠে দলবেঁধে বাঙালি ছেলেমেয়েরা ভিড় জমিয়ে ন্যাড়া পোড়াতো। যার রেশ কাটতে না কাটতেই ফুটে উঠতো দিনের আলো৷ ন্যাড়াপোড়ার জন্য সপ্তাহখানেক আগে থেকেই প্রস্তুতি চলতো। প্রথমে খেজুর পাতা কেটে তা শুকোতে দেওয়া হতো৷ দোলের আগের রাতে সেসব শুকনো পাতা নিয়ে এসে বাড়ি বানানো হতো৷ যে বাড়িকে বলা হয় 'বুড়ির ঘর'। তারপর তাতে আগুন জ্বালিয়ে পাড়ার ছেলে-ছোকরারা আনন্দে মেতে উঠতো। আর সকলের মুখে মুখে ফিরতো সেই ছড়াটি- "আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল!"  

বিশ্বায়নের চাপে ন্যাড়াপোড়া ক্রমশ অতীত হয়ে উঠছে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয় "বলো তো ন্যাড়াপোড়া কী?" তারা প্রায় সকলেই মাথা চুলকে বলবে "ন্যাড়াপোড়া আবার কী!" ন্যাড়াপোড়া নিয়ে আসলে কোনো চর্চায় তো হচ্ছে না তাই নতুন প্রজন্ম জানতে পারছে না ন্যাড়াপোড়ার কথা। তাছাড়াও এখনকার বাচ্চা ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণ ডুবে থাকে মোবাইল গেমে। আলপথে ছুটোছুটি করে ছোলাগাছ উপড়ে সেই ছোলাগাছ পুড়িয়ে খাওয়া, কাঁচা পেঁপের ভেতর রঙ ঢুকিয়ে কুমকুম তৈরি, বিচুলি, মাটির হাঁড়ি, পুরানো জামা, বাঁশের গায়ে লাগিয়ে সারা রাস্তায় ঘোরা একপ্রকার ভিন্ন আবেগ ছিল। সে আবেগে ভাটা পড়ে আজ ন্যাড়াপোড়া বিলুপ্তির পথে। নতুন প্রজন্ম স্মার্টফোন কপচিয়ে শুধুই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে স্ট্যাটাস আপলোড করতে। কানফাটানো ডিজের অত্যাচার এবং অপসংস্কৃতির ভিড়ে এখন বাঙালির বসন্ত উৎসব কোণঠাসা। 
 
পুরাণের গল্পকথা অনুযায়ী, শ্রীকৃষ্ণ ন্যাড়া রাক্ষসকে বধ করে দোলের সূচনা করেছিলেন বলে দোলের আগের দিন অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটাতে ন্যাড়াপোড়ার প্রচলন হয়। ন্যাড়াপোড়ার যে মহা আয়োজন আগে হতো সেসব যেন আজকে ম্লান। আজকাল মাত্র হাতে গোণা কিছু জায়গায় ধুমধাম করে ন্যাড়াপোড়া হয়ে থাকে। ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ন্যাড়াপোড়া নিয়ে গুটিকয়েক মানুষ আলোচনা করছেন বলে তবুও ন্যাড়াপোড়া কথাটি বেঁচে আছে। আগামীদিনে ন্যাড়াপোড়া নিয়ে চর্চা না হলে  ডাইনোসরের মতো লুপ্ত হবে ন্যাড়াপোড়া। 

ন্যাড়াপোড়ার কালচার কমে যাওয়ার আরো একটি বড়ো কারণ হলো শিল্পায়ন ও নগরায়নের বিকাশে বাংলার একের পর এক মাঠ চলে যাচ্ছে বেনিয়া গোষ্ঠীর হাতে। যার ফলে খোলা মাঠের সংখ্যা প্রচণ্ড পরিমাণে কমে যাচ্ছে। সাথে বাঙালির আধুনিক হওয়ার বড্ড খিদে বাঙালিকে নিজের সংস্কৃতি থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আর বাঙালির হীনমন্যতার ইঁদুরদৌড় তো রয়েইছে। ইতিহাসবিমুখও বর্তমানে বাঙালির এক ভয়াবহ সমস্যা। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি যত দিন যাচ্ছে ততই তলানিতে যাচ্ছে। বাঙালির সমস্ত দিক বিচার-বিবেচনা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে বাধ্য হয়ে এটাই বলতে হয় "যে বাংলার সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ন্যাড়াপোড়া।"

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments