Header Ads

এক কোটি গাছ লাগানোর সংকল্প মিশন গ্রিন ইউনিভার্সের


বর্তমান সময়ে শিল্প ও নগরায়নের জন্য ধ্বংস করা হচ্ছে সবুজ প্রকৃতিকে। মানুষের পাশবিক অত্যাচারে বদলে যাচ্ছে আমাদের চারপাশের পরিবেশ। যত দিন যাচ্ছে বিশ্বের নানান জায়গাতে দূষণ মাত্রা ছাড়াচ্ছে। পরিবেশ দূষণের ফলে কোপ পড়ছে বাস্তুতন্ত্রের ওপর৷ এভাবে চলতে থাকলে মানবজাতি ভবিষ্যতে এক ভয়ানক অবস্থার সম্মুখীন হবে। মানুষ যদি এখনই পরিবেশ বাঁচাতে অঙ্গীকারবদ্ধ না হয় তবে সেই দিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন পৃথিবীর সমস্ত জায়গায় কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ এতোটাই বেড়ে যাবে যে সকল মানুষকে প্রতি মুহূর্তে অক্সিজেন মাস্ক পরে জীবনযাপন করতে হবে। এরূপ অবস্থা যাতে মনুষ্য সমাজকে না দেখতে হয় তার জন্য গত ছয় বছর ধরে লড়াই করছে মুর্শিদাবাদের 'মিশন গ্রিন ইউনিভার্স' নামের একটি পরিবেশ সংগঠন।  


ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কথা হবে মিশন গ্রিন ইউনিভার্স এক কোটি গাছ লাগানোর সংকল্প নিয়েছে। ২০১৯ সালের ২৩ শে জানুয়ারি একটি পরিবেশ সম্মেলনের মাধ্যমে শুরু হয় এক কোটি গাছ লাগানোর আনুষ্ঠানিক অভিযান। যার জন্য তাঁরা তৈরি করেছে বীজ ব্যাঙ্ক যেখানে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পোস্ট অফিস বা কুরিয়ারের মাধ্যমে বা সরাসরি বীজ পৌঁছে যাচ্ছে মিশন গ্রিন ইউনিভার্সের নার্সারিতে। সেই বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। চারাগুলি সামান্য বড় হলে বিভিন্ন জায়গায় তা লাগানো হচ্ছে। এছাড়াও রক্তদান, বিয়েবাড়ি বা যে-কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে তাঁরা চারাগুলি বিলি করছেন৷ 

মিশন গ্রিন ইউনিভার্সের সদস্য-প্রতিনিধিরা পথের ধারে, মাঠে-ঘাটে, গাছের নীচে যা চারাগাছ বা বীজ পান তা সংগ্রহ করে আনেন এবং নিজ হাতে চারাগাছ উৎপাদন করে মানুষের হাতে তুলে দেন অথবা বৃক্ষরোপণ করেন। কারণ লক্ষ্য এক কোটি গাছ লাগানো। 


মিশন গ্রিন ইউনিভার্সের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অর্ধেন্দু বিশ্বাস লিটারেসি প্যারাডাইসকে বলেন, "পৃথিবীকে হত্যা করে মঙ্গল বা চাঁদে পালিয়ে যাওয়া হয়তো যায়, কিন্তু প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। তাই আমরা চাই আগামী পৃথিবীর জন্য একটি সুস্থ, সহনশীল প্রজন্ম, যারাই হবে আগামী সুস্থ পৃথিবীর অগ্রদূত। মানুষ পৃথিবীকে হত্যা করে মঙ্গল বা চাঁদে গিয়ে রেহাই পাবে কি? আমার বিশ্বাস বৃক্ষ রোপণ ও পরিবেশ আন্দোলনের মাধ্যমেই পৃথিবীতে সত্যিকারের বিপ্লব আসবে।"


মিশন গ্রিন ইউনিভার্সের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য অর্ধেন্দু বিশ্বাসের বাড়িটাই আজকে আস্ত নার্সারিতে পরিণত হয়েছে। অশ্বত্থ, নিম, কৃষ্ণচূড়া, মেহগনি, বট, বকুল, জাম, আম, তেঁতুল- কী নেই সেখানে। বাড়ির পিছনে কয়েক কাঠা জমিতে তিনি বকুল, নিমসহ বিভিন্ন ধরনের গাছের বীজ ফেলে চারা তৈরি করেছেন। ভাবতা-রাশিদিয়া নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তপন মণ্ডল জানিয়েছেন, "অর্ধেন্দু নিজে যেমন গাছ লাগাচ্ছেন তেমনই অন্যদেরও গাছ লাগাতে উৎসাহ দিচ্ছেন। তিনি নিজেই আমাদের স্কুলে শতাধিক গাছ লাগিয়েছেন।" 



সম্প্রতি ৪৫ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলাতে মিশন গ্রিন ইউনিভার্স 'গাছ বাঁচান, বই বাঁচান' নামে  পরিবেশ রক্ষার বার্তা দিয়ে চারাগাছ উপহার ও সচেতনতা শিবিরের আয়োজনে করেছিল৷ এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিরোধিতা করে শান্তিস্থাপনের উদ্দেশ্যে তাঁরা গাছ লাগানোর বার্তা দিয়েছেন। গত ২৮ শে ফেব্রুয়ারী জাতীয় বিজ্ঞান দিবসে তাঁরা বহরমপুরে চারগাছ বিতরণ কর্মসূচীর আয়োজন করেছিল। এভাবে তাঁরা নিজেদের লক্ষ্যে একনাগাড়ে কাজ করে চলেছেন৷ 


মিশন গ্রিন ইউনিভার্স গড়ে ওঠার পিছনে একটা বিস্ময়কর ঘটনা রয়েছে। মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত একটি প্রত্যন্ত গ্রামের ভাগচাষীর সন্তান অর্ধেন্দু বিশ্বাস। তিনি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় একদিন মাঠ থেকে ফিরে মা মা বলে চিৎকার করে ডাকে। কোনো সাড়া না পেয়ে কোঠা ঘরে মাকে আবিষ্কার করেন ঝুলন্ত অবস্থায়। মা হারা চার ভাইবোন নিয়ে শুরু জীবন সংগ্রাম। ভাগচাষী বাবার হাত ধরে প্রকৃতির ভাষা শেখেন তিনি। লেখাপড়ায় একেবারে মন ছিল না তাঁর। অনেক বড়ো বয়সে একদিন পাড়ার বন্ধুরা তাঁকে চ্যাং দোলা করে স্কুলে নিয়ে যায় জোর করে, কারণ স্কুলের গন্ডিতে তাঁর লেখাপড়ায় মন নেই, চাষের মাটি, বৃষ্টির ফোঁটা, বাবার ঘামের গন্ধ, প্রকৃতির খোলা আকাশ যে তার পাঠশালা। কিন্তু তার পর থেকে আর কোনো দিন পড়তে বলতে হয়নি তাঁকে। পাঁচ বছর বয়সী দুই জমজ ভাই - বোন, বৃদ্ধ ঠাকুমা, দাদা, বাবার জন্য রান্না বান্না করে রেখে স্কুলে দৌড়। কিন্তু তাতে পড়ালেখায় ভাটা পড়েনি। মাধ্যমিক পর্যন্ত স্কুলে প্রথম ছিলেন তিনি। স্কুল থেকে  ফিরে আবার মাঠে ছোটা। মাঠে চলতে চলতে গাছকে জড়িয়ে ধরে আদর করে মনের কথা বলা। তাকে ভালোবেসে লেখার চেষ্টা কবিতা, ছড়া, গল্প, প্রবন্ধ চর্চা। সাথে উচ্চ শিক্ষালাভ।


তিনি হঠাৎ একদিন "বৃষ্টি চোর" নামক একটি গল্প লিখেন। সেই কাল্পনিক গল্পে দেখানো হয়েছে অজ্ঞপুর নামে একটি এলাকায় টানা দশ বছর বৃষ্টি হয়নি।অনাবৃষ্টির ফলে অজ্ঞপুরে মহামারী শুরু হয়েছে। চারিদিকে জলের হাহাকার পড়ে গেছে। এমন সময় একজন হতদরিদ্র চোর তার স্ত্রীকে মহামারীতে হারিয়েছেন। কাল বাজারে চড়া দামে জল বিক্রি হচ্ছিল কিন্তু সেই চোর তার স্ত্রীকে জল কিনে খাওয়াতে পারেনি।জলের অভাবে তৃষ্ণায় তার স্ত্রী ছটপট করতে করতে মারা যায়। সে তার সন্তানকে কোলে নিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল যদি আবার বৃষ্টি না হয় তাহলে আমার সন্তান কি বাঁচবে? নাকি ঠিক তার স্ত্রীর মতো তাকেও হারাতে হবে? সন্তানের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে সেই চোর অন্যের বাড়ির জল চুরি করল। এই ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ালো। বিচারে এই বৃষ্টি চোরকে শাস্তি হিসেবে দশ বছরে দশ একর জমিতে গাছ লাগানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।  আদালতের নির্দেশে 'বৃষ্টি চোর' সেই গাছ লাগিয়েছিলেন। 

২০১৮ সালে এই গল্পের ইংরেজি অনুবাদ 'The Man Who Stole Rain' মুম্বাই আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের প্রতিযোগিতায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। গল্পের লেখক অর্ধেন্দু বিশ্বাস মুম্বাই থেকে ফেরার সময় ভাবেন সমাজের কজন আমার গল্প করবে? গল্প লিখে কি সমাজের পরিবর্তন সম্ভব? কেমন হয় যদি তারই গল্পের গাছ মানুষের চরিত্রের কাজটি যদি তিনি নিজেই শুরু করেন? সেই ভাবনা থেকে প্রকৃতি চেতনার কাজ শুরু করেন অর্ধেন্দু বিশ্বাস। শুরু হলো তার বৃক্ষ জীবন এবং এই কাজে তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন তাঁর কিছু বন্ধু বান্ধব ও ছাত্রছাত্রী। জন্মদিন অন্নপ্রাশন বিবাহ বড়দিন নববর্ষ সবকিছুতেই শুরু হলো গাছ উপহার দেওয়া অথবা বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। বই তৈরির কাগজ তৈরি হয় গাছ কেটে। তাই বই মেলাতেও গাছ উপহার দেওয়া হয়। লোকে তাঁকে চেতনার গাছ অর্থাৎ বিবেক বৃক্ষ বলে ডাকে। আস্তে আস্তে তৈরি করেন একটি নার্সারি সেখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে চারা সংগ্রহ করে গাছ উৎপাদন করা হচ্ছে এবং বিলি করা হচ্ছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ৩৬৫ দিন। ইতিমধ্যেই তিনি কয়েক লক্ষ গাছ মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন। নিজেই গাছে উঠে গাছ থেকে তিনি বীজ সংগ্রহ করেন, মাটি খোড়েন, বীজ থেকে চারা ফোটান ও মানুষকে উপহার দেন। এই কাজকে আরও ব্যাপকভাবে বিস্তার করার জন্য তৈরি করেছেন মিশন গ্রিন ইউনিভার্স নামে একটি পরিবেশ সংগঠন যাদের লক্ষ্য পৃথিবীতে একটি সবুজ সংস্কৃতি বা গ্রিন ফিলোজফির প্রসার করা।

প্রতিবেদন- সুমিত দে

1 comment:

  1. অসংখ্য ধন্যবাদ এভাবেই সবুজ সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ুক

    ReplyDelete