একের পর এক নীলকুঠি ধ্বংস করে ব্রিটিশদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল 'বিশু ডাকাত'
তিনি বাংলায় নীলকর সাহেবদের অত্যাচার নীরবে সহ্য করেন নি, বীরদর্পে তাদের চোখে চোখ রেখে তাদের ভাষায় কথা বলেছেন, নীলকুঠি আক্রমন করে পেশীর জোরে কুঠিতে বন্দি কৃষক-তাঁতীদের ছিনিয়ে এনেছেন, অবশেষে ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়ে শহিদ হয়েছেন৷ তাঁর কথা আলোচনা হলে মানুষ আজও শ্রদ্ধায় দু'ফোটা চোখের জল ফেলে তিনি নদীয়ার নীল বিদ্রোহের নায়ক বিশ্বনাথ সর্দার, ইংরেজদের কাছে বিশু ডাকাত৷ তাঁর জীবনীকাররা অবশ্য তাকে ভূষিত করেছেন 'বাংলার রবিনহুড' আখ্যায়৷
প্রতীকী ছবি |
ইংরেজদের কাছে হয়ত তিনি কুখ্যাত ডাকাত, কিন্তু বিশ্বনাথ সর্দার সাধারণ মানুষের কাছে ছিলেন সত্যিকারের 'রবিনহুড'। চিরকাল তিনি বাংলা ও বাঙালির মনে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত থাকবেন৷ প্রথম দিকে নীলের চাষ সীমিত হলেও পরে উর্বর জমিতে নীলের চাষ করতে বাধ্য করা হত চাষীদের, লাভের সিংহ ভাগ নীলকররা পেতেন, বাংলার চাষীর ভাগ্যে জুটত কেবল অর্ধাহার অথবা অনাহার৷ নামে বিচার ব্যবস্থা থাকলেও কৃষক সুবিচার পেতেন না, অবাধ্য চাষীকে বলপূর্বক নীল কুঠিতে আটকে রেখে দিনের পর দিন নির্মম নির্যাতন চালানো হত।
সুজলা সুফলা হিসেবে বাংলার প্রসিদ্ধি চিরকাল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার উর্বর মাটিতে নীল চাষ করে বিরাট অর্থ লাভ করছে, স্বভাবত চাষীদের নীল চাষ না করেও উপায় ছিল না৷ ধানের জমিতে নীল চাষে অনিচ্ছুক দরিদ্র কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে আর্বিভাব হয়েছিল 'রবিনহুড' বিশ্বনাথের, গায়ে প্রচণ্ড শারীরিক শক্তি, মনে অসীম সাহস, নিপীড়িত চাষীদের জন্য আকুল হয়ে উঠেছিল তাঁর হৃদয়৷ এদিকে নিজের যে অর্থবল বলে কিছুই নেই, দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহন করেছেন, কিভাবে তুলে দেবেন নিরন্নের হাতে অন্ন! ঘরে-ঘরে অনাহার, বিশ্বনাথ শেষ পর্যন্ত দরিদ্র মানুষের স্বার্থে ডাকাতির দল গড়লেন৷ কৃপণ ধনীর সর্বস্ব অপহরণ করে বিলিয়ে দিতেন অনাহার, অর্ধাহারে থাকা মানুষদের মধ্যে৷ সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বি, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে গরিবের প্রতীক, শুধু প্রতিবাদে ক্ষান্ত হলেন না, অন্যায়কারী কে দিতেন শাস্তি, নির্যাতিত মানুষদের সরব কণ্ঠ হয়ে উঠতে সময় লাগেনি৷
বিশ্বনাথের আক্রমনের লক্ষ্য ছিল কৃপণ ধনী জমিদার থেকে অত্যাচারী নীলকররা৷ ডাকাতি করতে যাবার আগে গৃহস্বামীকে জানিয়ে দিতেন তাঁর অতিথি হবেন, স্বেচ্ছায় অর্থ পেলে শক্তির অহেতুক প্রয়োগ করতেন না৷ তবে বাধা হলে শক্তির প্রয়োগ করতে হত একপ্রকার বাধ্য হয়ে৷ লুটের অর্থের সিংহভাগ দান করে দিতেন দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে৷ সেই অর্থে ঋণের জাল থেকে কত কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা মুক্তি পেয়েছেন দরিদ্র কৃষক কিনেছে হাল, নিরন্ন মানুষ দু'বেলা পেট ভরে খেয়েছে ভাত৷ গরিবের বেঁচে থাকার জন্য ছিল মাসোহারা সেই দানে বেঁচে থাকত শত-শত দরিদ্র পরিবার৷
বিশ্বনাথের এই উত্থান কে ভাল চোখে দেখার কথা নয় নীলকুঠির সাহেবদের, ঠিক যেমন সমাজের তথাকথিত ধনীরা তাঁর উত্থানে ভয় পেয়েছিল৷ অবশ্য ভয় বলে বস্তু কি জিনিস অজানা ছিল তাঁর, যেসব তাঁতী, কৃষক কে নীলকুঠির সাহেবরা কুঠিতে আটকে রাখতো, বিশ্বনাথ দলবল নিয়ে শক্তির প্রয়োগ করে তাদের ছিনিয়ে আনতেন, এদেশের যেসব লোক নীলকরদের সাহায্য করতো তাদের জন্য বরাদ্দ হত শাস্তি।
স্যামুয়েল ফ্রেডি নামের অত্যাচারী নীলকর সাহেব কে বেশ ভাল মত সবক শিখিয়েছিল বিশ্বনাথের দল৷ দাদন দিয়ে জোর করে চাষীদের নীল চাষে বাধ্য করত, তাকে যথোচিত শিক্ষা দিতে একদিন ফেডির কুঠিতে দলবল নিয়ে তুমুল আক্রমন করে বসলেন, উভয় পক্ষে হল সাংঘাতিক যুদ্ধ, লড়াই শেষে ফেডি পরাজিত, তাকে বন্দি করা হল, জঙ্গলেই বসল বিচার৷ অনুচররা বিশ্বনাথ কে বললেন এখনই তাকে হত্যা করা হোক৷ অবশ্য সাহেবের কাতর প্রার্থনায় ফেডি কে হত্যা না করে বিশ্বনাথ তাকে ছেড়ে দিলেন৷ ওদিকে ইলিয়ট সাহেব আর চুপ করে বসে থাকলেন না বিশ্বনাথ সর্দার কে ধরতে শুরু হল বিরাট উদ্যোগ, সেনাপতি ব্ল্যাকওয়ার এলো তাকে শাস্তি দিতে, যদিও কেউ বিশ্বনাথের নাগাল পায় নি, কারণ সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর ইমেজ রবিনহুডের, প্রবল জনপ্রিয়, তাঁর খবর ইংরেজদের কে দেবে৷ বিশ্বনাথ কে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষিত হল৷ দুর্ভাগ্য শুরু হল সেদিন বিশুর কয়েকজন অনুচর ধরা পড়লেন, এদের একজন ছিল বিশুর পালিত পুত্র, পুরস্কারের লোভে সেই খবর দিল তাঁর গোপন আস্তানার কথা৷
নদীয়া জেলার এক জঙ্গলে ছিল বিশুর গোপন ঘাঁটি, খবর পেয়ে ব্ল্যাকওয়ার সৈন্যদের নিয়ে এলাকা ঘিরে ফেললো৷ হয়ত যুদ্ধ করলে বিশু তীব্র লড়াই করতে পারতেন তবে সাথী-অনুচরদের রক্ষা করতে তিনি গোপন ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন আমি কোনও অন্যায় করিনি, যা করেছি কেবল উৎপীড়িত মানুষের স্বার্থরক্ষায়৷ এর জন্য তাঁর যা শাস্তি হবে তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করবেন৷ বন্দি করে বিশ্বনাথ কে পাঠানো হল জেলাশাসক ইলিয়টের কাছে, বিচারের নামে হয়েছিল প্রহসন৷ ইংরেজরা তাকে অভিহিত করল কুখ্যাত ডাকাত হিসেবে৷ ১৮০৮ সালে নদীর তীরে বিশ্বনাথকে ফাঁসি দেওয়া হল, সেই মৃতদেহ একটি লোহার খাঁচায় বন্দি করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল অশ্বথ গাছের ডালে।
বিশ্বনাথের উন্মাদিনী জননী ছুটে এলেন মৃত সন্তানের মৃতদেহ ভিক্ষা করতে, কেউ কর্ণপাত করেন নি বিশ্বনাথের মায়ের কথা৷ কিন্তু বিশ্বনাথ বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন নদীয়া সহ সারা বাংলার অগনিত মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়, বিশ্বনাথে কে স্মরণ করে মানুষ তাঁর উদ্দেশ্যে দু'ফোটা চোখের জল আজও ফেলেন৷
প্রতিবেদন- অরুণাভ সেন
তথ্যসূত্র- পলাশীর পরে বাংলার বিদ্রোহীদের অমরকাহিনী, সুধাংশু পাত্র।
Post a Comment