একটি পত্রিকার জন্যই কলকাতায় তৈরি হয়েছিল এক ডাকঘর
শহর কলকাতার প্রাচীন ভবনগুলির সাথে বটবৃক্ষের শিকড়ের মতো জড়িয়ে আছে ইতিহাস। এই ইতিহাস শহরের সেই নাগরিক সমাজের যাদের বহবর্ষী মননশীলতা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর হয়ে যায় ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে। তেমনই সময়ের দলিল বহন করে চলা এই শহরের একটি প্রাচীন ডাকঘর 'অর্চনা পোস্ট অফিস'।
কলকাতার বিভিন্ন সাব-পোস্ট অফিসের মতোই জোড়াসাঁকো এলাকার একটি ব্যস্ত ডাকঘর অর্চনা ডাকঘর। সাধারণত এলাকার নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বা এলাকার বিশেষ কোন স্থাপনার সঙ্গে মিলিয়ে ডাকঘরের নাম দেওয়া হয়। কিন্তু এই ডাকঘরের নাম অর্চনা হওয়ার কারণটি একেবারেই ভিন্ন। বাংলা সাহিত্যের একটি মাসিক পত্রিকার সঙ্গে অর্চনা ডাকঘরের নামকরণের বিশেষ যোগসূত্র আছে।
১৯০৪ সালে কৃষ্ণদাস চন্দ্র মহাশয় বাংলায় একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে অনুরোধ যায় নতুন পত্রিকার নামকরণের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য এবং সাহিত্য সমালোচনার এই পত্রিকার নামকরণ করেন 'অর্চনা'।
এই পত্রিকায় নিয়মিত ভাবে লিখতেন; কৃষ্ণদাস চন্দ্র, উমাচরণ ধর, সরসী বালা দেবী, নগেন্দ্রনাথ সোম, নলিনী ঘোষ, ফনীন্দ্রনাথ রায়, ধরিত্রী দেবী, কেশব চন্দ্র গুপ্ত, যতীন্দ্র কুমার দত্ত, ব্রজসুন্দর সান্যাল, ফকির চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো গল্পকার, কবি, সাহিত্যিকরা। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে অবাক লাগে মাত্র দুই বছরের মধ্যে 'অর্চনা পত্রিকা' এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে প্রতি সংখ্যায় তারা এক লক্ষ কপি পত্রিকা ছাপতে শুরু করে। আরও জানা যায় বছরে এক টাকা পঁচিশ পয়সা দিয়ে এই পত্রিকার গ্রাহক হওয়া যেতো। সময়টা আজ থেকে একশো আঠারো বছর আগে।
সেই সময়ে এলাকায় একটি মাত্র ডাকঘরের অস্তিত্ব ছিল, বড়বাজার পোস্ট অফিস। গ্রাহকদের ডাক যোগে বই পাঠানোর ঠেলায় ডাকঘরের অন্যান্য কাজ শিকেয় ওঠার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কর্মীদের নাকের জল চোখের জল অবস্থা। এই সময় কৃষ্ণদাস চন্দ্র মহাশয় ভাইসরয় লর্ড কার্জনকে চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি লেখনে 'অর্চনা' পত্রিকার জন্য একটি আলাদা সাব পোস্ট অফিস তৈরি করা দরকার। ভাইসরয় অবস্থা অনুধাবন করে রাজিও হয়ে যান। তৈরি হয় অর্চনা পোস্ট অফিস।
১৮, প্রভাতী চরণ ঘোষ লেনের একটি ছোট্ট ঘরে নতুন পোস্ট অফিস খোলা হয়। পরে নতুন ডাকঘর ১০ প্রভাতী চরণ ঘোষ লেনে স্থানান্তরিত হয়। আজও সেখানেই ডাকঘরটি অবস্থিত।
৫৬ বছর নিজের জনপ্রিয়তা বজায় রেখে চালু ছিল অর্চনা পত্রিকা। ১৯৬০ সালে পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলেও আজও পত্রিকার নামে তৈরি করা অর্চনা ডাকঘর গ্রাহকদের পরিষেবা দিয়ে আসছে। পত্রিকার নামে ডাকঘর কলকাতা শহরে একটি নয় আরও একটি ডাকঘর আছে, তার গল্প বলবো অন্য আরেক দিন।
প্রতিবেদন-অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়
Post a Comment