স্বাদেশিকতার অনুপ্রেরণায় খগেনচন্দ্র দাস তৈরি করেন মার্গো সাবান
এককালে বঙ্গ জীবনের অঙ্গ ছিল মার্গো সাবান, যখন মার্গো সাবানের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। মার্গো সাবান কেবল বাংলাতেই, এক সময় সারা ভারতেই রমরমিয়ে চলত মার্গো সাবানের একচ্ছত্র রাজত্ব। গাঢ় সবুজ বর্ণের ও নিমের গন্ধযুক্ত ঐতিহ্যময় সাবান হলো মার্গো। একদা বাঙালির গ্রীষ্মকাল অসম্পূর্ণ থেকে যেত মার্গো সাবান গায়ে না মাখলে। কালের নিয়মে ব্যবহার কমেছে শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া এই সাবানের।
শতাব্দী প্রাচীন মার্গো সাবানের জন্ম হওয়ার পিছনে লুকিয়ে আছে এক অসামান্য ইতিহাস। এক বাঙালি ব্যবসায়ী যিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তৈরি করেছিলেন মার্গো সাবান। কিন্তু কীভাবে?
ব্রিটিশ ভারতের প্রথম সারির অন্যতম উদ্যোগপতি ও ব্যবসায়ী খগেনচন্দ্র দাসের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়েছিল মার্গো সাবানের। অষ্টাদশ শতকের একেবারে অন্তিম লগ্নে কলকাতার এক বৈদ্য পরিবারে জন্ম হয় খগেনচন্দ্র দাসের। পিতা রায়বাহাদুর তারক চন্দ্র দাস ছিলেন পেশায় বিচারপতির। মা মোহিনী দেবী ছিলেন 'মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি'-র সভাপতি। মূলত মায়ের অনুপ্রেরণাতে শৈশব থেকেই তাঁর মনে জাগ্রত হয় স্বদেশ প্রেম। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তিনি অতি সক্রিয় ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে। বাংলায় তখন তিলে তিলে দানা বাঁধছে স্বদেশী আন্দোলন। বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কালে ব্রিটিশদের প্রকৃত স্বরূপ চিনতে শুরু করছে বাঙালি সমাজ।
পড়াশোনার পাঠ শেষ করে শিবপুর কলেজে অধ্যাপনা করতে শুরু করেন খগেনচন্দ্র। সেখানেই তিনি জড়িয়ে পড়েন ব্রিটিশ বিরোধী বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। সেসময় ব্রিটিশ পুলিশের গ্রেপ্তারির হাত থেকে ছেলেকে বাঁচাতে তাঁর পিতা তাঁকে রাতারাতি বিলেতে পাঠিয়ে দেন। বিলেতে অবস্থান কালে খগেনচন্দ্র স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা হরদয়ালের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের অন্যতম সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন।
তিনি বিলেতে পড়াশোনা করার সময় ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর দ্য এডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্টিফিক ইন্ডাস্ট্রি থেকে বৃত্তি পান। যে বৃত্তি পেয়ে তিনি সোজা পাড়ি দেন আমেরিকাতে। মার্কিনমুলুকে প্রথমে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রের পড়াশোনা শেষ করেন খগেনচন্দ্র। এই সময় তাঁর সহপাঠী ছিলেন সুরেন্দ্রমোহন বসু৷ যিনি পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিখ্যাত ডাকব্যাক। এরপর তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে জাপান চলে যান। জাপানের বণিকদের কাছ থেকে তিনি ব্যবসার কতগুলো সহজ উপায় শিখেছিলেন। কিছু বছরের মধ্যেই দেশে ফিরে তিনি ১৯১৬ সালে আর.এন.সেন এবং বি.এন.মৈত্র কে পাশে নিয়ে তিনজলার পণ্ডিতিয়া রোডে প্রতিষ্ঠা করলেন 'ক্যালকাটা কেমিক্যাল কোম্পানি'। যেখানে তিনি টয়লেট সামগ্রীও তৈরি করেছিলেন। তাছাড়াও তিনি ভারতে প্রথম মার্গো সাবান এবং নিম ফেসপ্যাকও উৎপাদন শুরু করেছিলেন।
স্বাদেশিকতার অনুপ্রেরণায় গড়ে ওঠা 'ক্যালকাটা কেমিক্যাল কোম্পানি' তৈরি করতে থাকে একেবারে খাঁটি দেশীয় পণ্য। যার দামও একেবারে সস্তা, যা নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষও অনায়াসে ব্যবহার করতে পারেন। খগেনচন্দ্র দাস তৈরি করলেন ল্যাভেণ্ডার পারফিউমও। ক্রমশ চূড়ান্ত জনপ্রিয়তার কারণে ভারতের অন্যান্য সব বড় শহরেও প্রতিষ্ঠিত হলো ক্যালকাটা কেমিক্যাল কোম্পানির শাখা। ভারতের সর্বত্র এতোই বিপুল চাহিদা বাড়ল মার্গো আর ল্যাভেণ্ডারের যে তামিলনাড়ুতে পৃথকভাবে নিমের বাগান তৈরি করতে হলো। এরপর ভারতের সীমানা অতিক্রম করে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লো এর সুখ্যাতি। তার জেরেই সিঙ্গাপুরে প্রতিষ্ঠিত হলো কোম্পানির আরও একটি শাখা।
খগেনচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর বংশধরেরা কারখানার হাল ধরেছিল। কিন্তু সময়ের চোরাস্রোতে তা হারিয়ে যায়। ২০০১ সালে দাঁড়িয়েও মার্গো সাবানের ব্র্যান্ডভ্যালু ছিল ৭৫ কোটি টাকা। দূর্ভাগ্যের বিষয়, আজ এই কোম্পানি আর বাঙালির নেই। জার্মানির বিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানি হেঙ্কেল কিনে নেয় এই ব্র্যান্ড।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment