Header Ads

ঐতিহাসিক বাংলা ছবি '৮/১২' যেন অলিন্দ যুদ্ধের এক জীবন্ত মহাকাব্য


বাংলার অগ্নিযুগের তিন নায়ক বিনয়-বদল-দীনেশের বিখ্যাত রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান ও অলিন্দ যুদ্ধের কথা আমরা সকলেই জানি। এইবার বিনয় বদল দীনেশের সেই রাইটার্স বিল্ডিং-এর অলিন্দ যুদ্ধ নিয়ে সিনেমা বানালেন বিখ্যাত পরিচালক অরুণ রায়, নাম '৮/১২'।ঐতিহাসিক ছবি 'এগারো' ও 'হীরালাল' এর পর '৮/১২' - র মতো একটি অসাধারণ সিনেমা উপহার পাওয়ার জন্য বাঙালি স্বাভাবিক ভাবেই খুশি।


সিনেমা শুরু হচ্ছে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার পুনরুদ্ধারের পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে দেখানো হচ্ছে যে চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্য সেন ও তাঁর দলের প্রতিরোধের মুখে পড়ে ভীত সন্ত্রস্ত ব্রিটিশ পুলিশ। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ পুলিশ মাস্টারদাকে খুঁজতে আরো বেপরোয়া হয়ে বাঙালি নারী এমনকি স্কুলের শিশুদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। এই অত্যাচারের নেপথ্যে থাকা লোম্যানকে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের হয়ে হত্যা করেন মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্র বিনয় কৃষ্ণ বসু। তার পর এক মুসলিম কৃষকের ছদ্মবেশে কলকাতায় চলে আসেন।

বাংলা তথা ভারত বিনয়ের পক্ষে নিরাপদ নয় তাই বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের উচ্চ নেতৃত্ব ওনাকে ইতালি গিয়ে বিপ্লবের কার্যকলাপ চালাতে বললে উনি তা অস্বীকার করেন এবং সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের ভীত নাড়িয়ে দিতে রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের পরিকল্পনার কথা বলেন। সেই মতো শীর্ষ নেতৃত্বকে সব আয়োজন করতে বলে। নেতৃত্ব বহু চেষ্টার পরও অভিযান চালিয়ে তাঁদের জীবিত অবস্থায় ফেরার পথ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু বিনয় স্পষ্ট জানায় যে এই মুহূর্তে দেশের কিছু তরুণের বলির প্রয়োজন। বিনয় সহযোদ্ধা রূপে পায় ১৮ বছরের বাদল ও ১৯ বছরের দীনেশকে।

১৯৩০ সালের ৮ ই ডিসেম্বর গুলির আওয়াজে কেঁপে ওঠে রাইটার্স বিল্ডিং। ইউরোপীয় পোশাকে বাংলা মায়ের তিন দামাল তরুণ দখল নিয়েছে রাইটার্স বিল্ডিং। ক্ষণিকের জন্য হলেও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বাংলার এক টুকরো জমি। প্রথমেই ঢুকে তারা গুলি করে কারা বিভাগের প্রধান আইজি সিম্পসনকে। তার পর অন্য এক কর্তার কক্ষে যাওয়ার আগেই লুকিয়ে পড়ে সেই আধিকারিক। এইদিকে ততক্ষণে পুলিশের সাথে শুরু হয়ে যায় এক অসম লড়াই। একদিকে অসাধারণ তিন তরুণ বাঙালি যোদ্ধা অন্যদিকে একদল ব্রিটিশ পুলিশ। তবুও এই তিন বীরের সাথে পেরে উঠছিল না পুলিশ, আনা হয় অতিরিক্ত বাহিনী। কিন্তু গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় কোণঠাসা হয়ে পড়েন তিন বিপ্লবী। পরিকল্পনা মতো বাদল পটাশিয়াম সায়ানাইড খায়,  দীনেশ পটাশিয়াম সায়ানাইড খায় ও নিজেকে গুলি করে ও বিনয় নিজেকে গুলি করে প্রাণ উৎসর্গ করে।

অসাধারণ এই সিনেমাটির অভিনয়, নির্দেশনা, আবহ সঙ্গীত, গান ও ক্যামেরার কাজ সবকিছুই একেবারে নিখুঁত। সম্পূর্ণ সিনেমাটি সাদা কালো, সিলেক্টিভ হিসেবে আছে লাল রং। অ্যাকশন দৃশ্যের সময় ব্যবহৃত হেভি গিটার ও মেটাল রকের মিউজিক দৃশ্যগুলোতে আলাদা মাত্রা যোগ দিয়েছে। শীর্ষ নেতৃত্বের মিটিংয়ের দৃশ্যটি সুচিন্তিত ও সুদক্ষ ভাবে সৃষ্টি।

ছবিটির প্রতিটি দৃশ্যকে খুব গভীর গবেষণা করে প্রাণ দেওয়া হয়েছে। ছবিটিতে তিনজন বিপ্লবীর চরিত্র সৃষ্টির সময় তাঁদের ব্যক্তিত্বের প্রতিটি সূক্ষ্ম বিষয়ের ওপর পরিচালক বিশেষ যত্নশীল ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে লোম্যানকে হত্যার দৃশ্যটির কথা। বিদ্যুতের গতিতে লাফিয়ে বিনয় আসে এবং হত্যার পর পালানোর সময় বন্দুকটা ফেলে দেয়।  এক সাহেবপ্রেমি বাঙালি তাঁকে বাধা দেওয়ায় তাঁকে এক মুষ্ঠাঘাতে ফেলে দেন। এই প্রতিটি বিষয় ঐতিহাসিক ভাবে নিখুঁত। বিনয়-বাদল-দীনেশ এই তিন বিপ্লবীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন যথাক্রমে অভিনেতা কিঞ্জল নন্দ, অভিনেতা অর্ণ মুখোপাধ্যায় এবং অভিনেতা রেমো। চরিত্র তিনিটিকে জীবন্ত করে তুলেছেন এই তিন অভিনেতা। স্বল্পভাষী বিনয়ের দৃঢ়তা, প্রাঞ্জল বাদলের স্ফুর্তী এবং দীনেশের সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি ভালোবাসা এই সব ফুটে উঠেছে এই তিনজনের অভিনয়ে। তাছাড়া বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের নেতা হেমচন্দ্র ঘোষের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিখ্যাত অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। অন্যান্য সকল চরিত্র গুলিও অসাধারণ ভাবে ফুটে উঠেছে অভিনেতাদের অভিনয়ে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গুলশনারা খাতুন অভিনীত কমলার চরিত্রটি।

'৮/১২' সারা জীবন মনে রাখার মতো একটি সিনেমা। এই ছবিটি অত্যন্ত তথ্যবহুল ও গবেষণামূলক। স্কুলের ইতিহাস বইয়ের বাইরে বিনয়-বাদল-দীনেশকে সকল বাঙালি নতুন ভাবে খুঁজে পাবেন এই ছবিতে। নিজের দীর্ঘ গৌরবময় লড়াইয়ে ইতিহাস আজ বাঙালি ভুলে যেতে বসেছে ঠিক এমন সময়ে এইরূপ একটি সিনেমা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই ছবিটি সকল বাঙালির দেখা উচিত। এ ছবিকে রেটিং দিয়ে বিচার করা যায় না। এই ছবি স্টার রেটিং- এরও উর্দ্ধে। তাঁরা দিয়ে সূর্যের বিচার করা যায় না।

প্রতিবেদন- অভিষেক পাল


No comments