ট্যাটুকে পেশা করে মাসে লাখ টাকা আয় করেন বাঙালি ব্যবসায়ী অনিন্দ্য ঠাকুর
অনিন্দ্য ঠাকুর এই ব্যক্তিটিকে অনেকেই হয়তো চেনেন না। কিন্তু এনার সম্পর্কে একটু আলোচনা দরকার। এই প্রতিবেদনটি আসলে তাঁকে নিয়েই লিখছি। খড়দার বাসিন্দা অনিন্দ্য ঠাকুর পেশায় একজন ট্যাটু শিল্পী। তাঁর জীবনটাও শুরু হয়েছে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো করেই। তাঁর প্রথম জীবনে মা, বাবা ও তাঁকে নিয়ে ছিল ছোটো সুখী পরিবার। তাঁর জীবনে অন্ধকার নেমে এলো যখন তাঁর বয়স মাত্র নয় বছর। এই সময় তিনি তাঁর বাবাকে হারিয়ে বাবা না থাকার শূন্যস্থানটা উপলব্ধি করেন। তাঁর মা ও তিনি দুজনেই মানসিক এবং আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, এমন সময় আশপাশের মানুষজন তাঁর মা-কে বলেন যে তাঁর ছেলেকে বোর্ডিং-এ রেখে দিয়ে আসতে। কিন্তু তাঁর মা তাদের কথায় কান না দিয়ে মা ও বাবা দুজনের অভাবটা পূরণ করেন একাই।
অনিন্দ্য বাবু আজ যেখানে দাঁড়িয়ে তা সম্ভব হতো না যদি তাঁর মা না থাকতো। তাঁর মা তাঁকে ছোটো বয়স থেকেই আঁকার ক্লাসে পাঠাতেন। পরবর্তীকালে এই আঁকাটা তাঁর শখে পরিণত হয়। তিনি ভাবতে থাকেন যে, কী করে তাঁর এই শখকে পেশাতে পরিবর্তন করবেন এবং নিজেকে একজন উপার্জনশীল নাগরিক রূপে প্রতিষ্ঠিত করবেন? তিনি আত্মউপলব্ধি করেন যে তাঁর মা-এর ওপর অনেক চাপ তাই তিনি উপার্জন করে মায়ের স্বাবলম্বী হতে চান।
তিনি বৃথা সময় অপচয় না করে আঁকাতে মনযোগী হন এবং তাঁর সাথে সাথে তিনি আড়াইশো টাকাতে আঁকার একটি ব্যাচ শুরু করেন। তিনি সেই সময় থেকে একটু একটু করে নিজের দায়িত্ব নিতে শিখেন। তবে সব ঠিকঠাক চললেও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক আগে মা-এর মানি মার্কেট ও তাঁর সঙ্গে গার্মেন্টস-এর ব্যবসাটাও বন্ধ হয়ে যায়। এই বেহাল পরিস্থিতি তাঁদের জীবন জীবিকাই একটা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে হাজির হয়। এমতাবস্থায় অনিন্দ্য বাবু একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত হন লোকাল ইলোক্টসিল কোম্পানির ওয়েট ব্রিজে। এই কাজটা ছিল ব্রিজে যত গাড়ি আসবে সেই গাড়িগুলোর ওজন পরীক্ষা করা। তিনি সেখানে নাইট ডিউটি করতেন কেননা তাঁকে রাত্রি নটা থেকে সকাল নটা পর্যন্ত কাজ শেষ করে টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফিরতে হতো। এই কাজের জন্য তাঁকে বেতন দেওয়া হতো মাত্র তিন হাজার টাকা। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর তিনি তাঁর শখকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু সেই খরচ কোথা থেকে আসবে তা ঠিক ছিল না। কিন্তু অনিন্দ্য বাবুর অদম্য ইচ্ছাশক্তি ছিল। তাই তিনি আর্ট কলেজে আঁকার পাশাপাশি ট্যাটু আঁকার উপকরণের জন্য অর্থ সঞ্চয় করতে থাকেন।
বারংবার এই ট্যাটুর কাজে ব্যর্থ হন তিনি। একসময় তাঁর মনে হয় এ কাজ তাঁর জন্য হয়তো নয়। সেকথা তিনি তাঁর মাকেও বলেন। কিন্তু তাঁর মা তাঁকে এই কাজ মন দিয়ে করে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। তাঁর মা তাঁকে বলেন যে, সময় খুব কম তাই কম সময়ের মধ্যে তাঁকে স্বাবলম্বী হতে হবে। মায়ের কথাতে তিনি ভেঙে না পড়ে অদম্য জেদ ও নিষ্ঠার সঙ্গে ২০১৮ সালের ১ লা ফেব্রুয়ারী তিনি ২০,০০০ টাকা হাতে নিয়ে একটি স্বপ্নের ট্যাটুর দোকান খুলে বসেন। কিন্তু প্রথমে সেভাবে তাঁর দোকান প্রচারের আলোয় আসেনি। তবে কিছুদিন চলার পর তাঁর ট্যাটুর দোকান মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে। বিশ্বনাথ নামের এক ব্যক্তি সহায়ক হিসেবে তাঁর ট্যাটুর দোকানের সঙ্গে যুক্ত হন। অনিন্দ্য বাবুর অনুপস্থিতিতে বিশ্বনাথ বাবু ঐ ট্যাটুর দোকানের দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নেন।
প্রথম দোকান দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর অনিন্দ্য বাবু আরও একটা দোকান খোলেন ভাড়াতে। কিন্তু এই সময় করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ায় তার ব্যবসায় ভাটা পড়ে, একদিকে দোকানের ভাড়ার টাকা, কর্মচারীদের বেতন, অন্যদিকে নিজের জীবন জীবিকা সব স্থির হয়ে পড়ে। কিন্তু অনিন্দ্য বাবু হার মানার পাত্র নন, তিনি সমস্ত বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে শেষমেশ জনপ্রিয় করে তোলেন নিজের ট্যাটুর দোকানটা। তিনি স্বল্প বাজেটে অনেক ট্যাটুর কাজ করতে থাকেন এবং বিভিন্ন সময় উৎসব অনুষ্ঠানেও তাঁর ট্যাটুর খরচ নিশুল্ক বা ফ্রী করে দেন। অবশেষে নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অনিন্দ্য ঠাকুর সফল ও উপার্জনশীল নাগরিকে পরিণত হন এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর পরিচিতি তৈরি হয়। বর্তমানে ট্যাটু ব্যবসা করে তিনি মাসে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করেন।
তাঁর এক আত্মীয় একদিন তাঁকে বলেছিলেন যে ট্যাটু অঙ্কন করে তার কত টাকা রোজগার হয়। অনিন্দ্য বাবু বলেন, তাঁর আত্মীয় বার্ষিক যা আয় করেন তিনি তা একমাসেই আয় করেন। এই কথা শোনার পর তাঁর আত্মীয় স্তম্ভিত হয়ে যান।
অনিন্দ্যবাবু মনে করেন, "জীবনে সফল ব্যক্তি বা উপার্জনশীল নাগরিক হতে গেলে প্রথমে নিজের চাহিদা পূরণের পর বাকি অর্থ সঞ্চয় করতে হবে। তারপর সময় মতো নির্ধারিত অর্থ ছাড় দিতে হবে। এরপর ভালো পরিষেবা দেওয়ার ব্যাপারে যত্নশীল হতে হবে।"
প্রতিবেদন- সৌমেন হেলানী
Post a Comment