দক্ষিণেশ্বর কালী মূর্তির কষ্টি পাথর সংগ্রহ করতে আস্ত পাহাড় কেনেন নবীন ভাস্কর
বাংলার এক ঐতিহ্যবাহী কালী মন্দির হলো দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির। যা প্রতিষ্ঠা করেন রাণি রাসমণি। মন্দিরের মা ভবতারিণীর পুজো দিতে প্রতিদিন পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে আসেন৷ এই ভবতারিণীর মূর্তি প্রতিষ্ঠার পিছনে এক অজানা ইতিহাস রয়েছে, যা হয়তো আমরা অনেকেই জানি; আবার অনেকেও জানিও না। কী সেই ইতিহাস?
দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের যখন নির্মাণ কাজ আরম্ভ হয় তখন রাণী রাসমণি একজন নামকরা ভাস্করের খোঁজ করতে থাকেন, যাকে দিয়ে তিনি তাঁর স্বপ্নের ভবতারিণীর মূর্তি গড়াবেন। রাণীমার গুরুদেব নবীন চন্দ্র ভাস্কর নামের বঙ্গের একজন নামকরা ভাস্করের সন্ধান দেন। যার হাতে তৈরি ভাস্করের সুনাম বঙ্গদেশের প্রত্যেক কোণায় কোণায় পৌঁছে গিয়েছিল।
নবীন ভাস্কর জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৬ সালে বর্ধমান জেলার দাঁইহাট গঞ্জে। নবীন ভাস্করের বাবা রামচন্দ্র ভাস্কর কলকাতার ৩৭৪ নম্বর আপার চিৎপুর রোডে 'ওরিয়েন্টাল স্টোন ওয়ার্কস' নামে একটি পাথরের মূর্তি নির্মাণের কারখানা তৈরি করেছিলেন। শৈশব থেকেই নবীন ভাস্করের শিল্প দক্ষতা প্রকাশ পায়।
রাণী রাসমণি সৈন্য নিয়ে কলকাতা থেকে ছুটে এলেন পূর্ব বর্ধমানের সেই প্রত্যন্ত গ্রামে দাঁইহাটে শিল্পী নবীন ভাস্করকে মায়ের মূর্তি গড়ার বরাত দিতে। কিন্তু হঠাৎ নবীন ভাস্কর মূর্তি বানাতে অস্বীকার করলেন। রাণীমা হতাশ হয়ে খালি হাতেই ভগ্ন হৃদয়ে কলকাতা ফিরে এলেন৷ নবীন ভাস্করের অস্বীকার করার কারণ অবশ্যি একটাই। কী সেই কারণ? সেকেলে জাতপাত নিয়ে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণে বিশাল যুদ্ধ বেঁধে যেত। রাণী মা ছিলেন অব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। তার ওপর একজন মহিলার কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে ছিল না সেকালীন গোঁড়া ব্রাহ্মণরা। তাই জাত চলে যাওয়া ও সমাজচ্যুত হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি রাণী মাকে না বলে দিয়েছিলেন।
নবীন ভাস্কর রাণিমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কিছুদিন পর এক বিপত্তি দেখা যায়; তিনি যখন অন্য একটি কালী মূর্তি গড়ছিলেন তখন সেই মূর্তিটা বারংবার ভেঙ্গে যাচ্ছিল। নবীন ভাস্কর বুঝতে পারলেন রাণী মাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ফলেই মা কালী হয়তো তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন। অতএব তিনি স্থির করলেন সমাজচ্যুত হলে হবেন তবুও রাণিমাকে মন্দিরের জন্য কালী মূর্তি গড়ে দেবেন। তাই তিনি সাহস করেই রাণিমার দরবারে সশরীরে কলকাতা এলেন রাণী মায়ের কাছে মূর্তি বানানোর অনুরোধ নিয়ে। রাণী রাসমণি খুশি হয়ে নবীন ভাস্করকে তাঁর স্বপ্নে দেখা মায়ের মূর্তির রূপ বর্ণনা করলেন। মায়ের মূর্তি বানানোর জন্য ভালো কষ্টি পাথর সংগ্রহ করতে নবীন ভাস্কর বর্ধমানের রাজার সাহায্যে বিহারের জামালপুরের একটা গোটা আস্ত পাহাড় কিনে ফেলেছিলেন। তারপর মাসাধিকাল ধরে হবিষান্ন খেয়ে আচার মেনে সেই সময় নবীন ভাস্কর কলকাতায় নিজেদের স্টুডিও 'ওরিয়েন্টাল স্টোন ওয়ার্কস'এর ঘরে বসেই দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মূর্তি নির্মাণ করেন।
মূর্তির কাজ শেষ হলে তিনি মূর্তিটি রানিমাকে দেখান। মূর্তিটি রানিমার বেশ পছন্দ হয়। তবে এই মূর্তিটিকে ঘিরে সমস্যা দেখা গেল। মন্দিরের গর্ভগৃহের সঙ্গে ঠিক ঠিক মাপে গোলযোগ রয়েছে মূর্তিটির৷ রানিমার ইচ্ছায় পুনরায় মূর্তি গড়লেন নবীন ভাস্কর। দ্বিতীয় মূর্তিতেও সমস্যা দেখা যায়৷ দ্বিতীয় মূর্তিটি আবার একটু বড় হল গর্ভগৃহের মাপে। ফলে, তৃতীয়বার মূর্তি গড়ার কাজ আরম্ভ করলেন নবীন ভাস্কর। এবার আর কোনো সমস্যা হলো না। তৃতীয় মূর্তিটিই অবশেষে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হলো। আমরা বর্তমানে সেই বিগ্রহটিই দর্শন করি।
নবীন ভাস্করের হাতে নির্মিত তৃতীয় মূর্তিটি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে প্রতিষ্ঠা হলেও অপর দুই মূর্তিও অন্যত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুতরাং, মা ভবতারিণীর আদলে আরও দুটি মূর্তি আছে, তবে তাঁরা পূজিতা হন অন্য নামে। রাণি রাসমণির উইল অনুযায়ী, দক্ষিণেশ্বরের এই কালীমূর্তির নাম জগদিশ্বরী। শোনা যায়, নবীন ভাস্করই মায়ের নাম দিয়েছিলেন 'ভবতারিণী'।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
তথ্যসূত্র- ডাবল হাফ অনলাইন পোর্টাল, দুর্গাফেস্ট ডট কম
Post a Comment