পৃথিবীর দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে জন্ম হয় আজকের পুরুলিয়ার
"বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর"। বাংলার রূপবৈচিত্র্যের অন্যতম উপাদান হলো বাংলা ভাষা। যা আমাদের মায়ের ভাষা। বাংলা ভাষা হলো পৃথিবীর একমাত্র ভাষা যে ভাষার জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয়েছে। ১ লা নভেম্বর বাংলা ভাষার ইতিহাসে স্মরণীয় একটা দিন।
১৯৫৬ সালের ১ লা নভেম্বর জন্ম হয় পুরুলিয়া জেলার। এই দিন বিহারের মানভূম জেলা ভেঙে নতুন একটি জেলা পশ্চিমবঙ্গের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার নাম দেওয়া হয় পুরুলিয়া। বাঙালি আজকে ভুলে গেছে এ দিনটির তাৎপর্যের কথা। এক কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এ অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়েছিল। প্রতিটি বাঙালিকে মানভূম সংযুক্তি দিবসের কথা মনে রাখতে হবে। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রথম লড়াই হলো 'মানভূম ভাষা আন্দোলন'। এপার বাংলার বৃহত্তর ভাষা আন্দোলন হলো 'মানভূম ভাষা আন্দোলন।'
ওপার বাংলাতে উর্দু আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল তারও পূর্বে এপার বাংলাতে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ১৯১১ সালের ১২ ই ডিসেম্বর মানভূম ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এই আন্দোলন শেষ হয় ১৯৫৬ সালের ১ লা নভেম্বর। দীর্ঘ ৪৫ বছর সময় লেগেছিল পুরুলিয়া জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। প্রায় ১১ লক্ষ ৬৯ হাজার ৯৭ জন এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পর ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে রূপান্তরিত করা হয়। একই সঙ্গে তৈরি হয় বিহার ও ওড়িশা দুটি পৃথক রাজ্যের। মানভূম ও ধলভূম এই দুটো জেলাকে ঐ দুটো রাজ্যের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়। মানভূম ও ধলভূম উভয় জেলার প্রধান ভাষা বাংলা। মানভূমের মতো ধলভূমে ভাষা আন্দোলন হলেও ধলভূমকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করানোর জন্য বাঙালি ব্যর্থ হয়েছিল।
১৯১১ সালে মানভূম সংযুক্তির জন্য আন্দোলন শুরু হলেও ১৯৪৮ সাল থেকে আন্দোলন বৃহত্তর আকার নেয়৷ ১৯৪৮ সালে তৎকালীন বিহার সরকার মানভূমের মানুষদের ওপর জোর করে হিন্দি চাপানোর প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। শিক্ষা-দীক্ষা চাকরি সবেতেই বাংলা ভাষার অধিকারকে খর্ব করা হয়। প্রাথমিক স্তর থেকে সরকারি অনুমোদিত স্কুল সব জায়গাতে এক রকম জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হয়। ওখানকার বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বাংলা ও হিন্দিতে শিক্ষা শুরু হলেও আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে কেবল হিন্দি মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান আরম্ভ হয়। বাঙালিরা বাংলা ভাষার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাদের ওপর জুলুম করা শুরু হয়। কেউ বাংলা ভাষাতে কথা বললে তার ওপর শারীরিক অত্যাচারও শুরু করা হয়।
বাঙালির ওপর অকথ্য অত্যাচার মানভূমের কেউই মেনে নিতে পারেনি। সেখানকার সকল বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণআন্দোলনের ডাক দেয়। অতুলচন্দ্র ঘোষ, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ ও বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত সহ ৩৭ জন নেতা কংগ্রেস দল ত্যাগ করে 'লোক সেবক সংঘ' গঠন করেন। বাংলা ভাষার পদমর্যাদার দাবীতে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করে এই সংঘ।
বিহার নিরাপত্তা আইন এনে বিহার সরকার বাঙালিদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালাতে থাকে। এর বিরুদ্ধে টুসু গানের মাধ্যমে প্রতিবাদ শুরু হয়৷ সে সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে "শুন বিহারী ভাই তোরা রাইখতে লারবি ডাং দেখাই" গানটি। আন্দোলনের মূল মন্ত্র হয়ে উঠেছিল এ গান৷ এই আন্দোলনে নারীবাহিনীদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, ভাবিনী মাহাতো, রেবতী ভট্টাচার্য মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন আন্দোলনে। বিহারী রাজনৈতিক দুষ্কৃতিরা লাবণ্যপ্রভা ঘোষের চুলের মুঠি ধরে বাড়ি থেকে বের করে তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। রেবতী ভট্টাচার্যকে বিহার পুলিশ পিটিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় জঙ্গলে রেখে দেয়। ভাবিনী মাহাতোর ওপরও অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। কুখ্যাত বিহার জননিরাপত্তা আইনে ভাবিনী মাহাতো, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ, ভজহরি মাহাতো ও অশোক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৫২ সালের লোকসভা নির্বাচন মানভূম ভাষা আন্দোলনকে অক্সিজেন জোগালো। ঐ নির্বাচনে লোকসেবক সংঘের প্রার্থী ভজহরি মাহাতো ও চৈতন্য মাঝি সহ সাতজন প্রার্থী জয়লাভ করেন।
১৯৫৬ সালের এপ্রিলে লোক সেবক সংঘের আন্দোলনকারীরা পায়ে হেঁটে পুরুলিয়া থেকে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। ২০ শে এপ্রিল থেকে ৬ ই মে টানা ষোলোদিন ধরে লংমার্চ করে আন্দোলনকারীরা কলকাতা পৌঁছান। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান সেদিন। কলকাতা থেকে হেমন্তকুমার, মোহিত মৈত্র, সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা লংমার্চে অংশ নেয়৷ তারা যাতে সমাবেশ না করতে পারেন তার জন্য তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। এই ধারা ভঙ্গ করে মিছিল এগিয়ে চলে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য কলকাতা থেকে ৯৬৫ জন আন্দোলনকারীকে বন্দী করা হয় ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জায়গা থেকে ৩,৩০০ জন আন্দোলনকারীকে বন্দী করা হয়। সকল বন্দীদের গ্রেপ্তার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল, প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয়। প্রায় বারোদিন পর সকলকে মুক্তি দেওয়া হয়।
বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়ে ১৯৫৬ সালের ১৭ ই আগস্ট লোকসভায় ও ২৮ শে আগস্ট রাজ্যসভায় বাংলা-বিহার সীমান্ত নির্দেশ বিল পাস হয়৷ ১লা সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি এই বিলে সই করেন৷ অবশেষে ১লা নভেম্বর মানভূমকে তিন টুকরো করে বাংলা অধ্যুষিত ১৬ টি থানা জুড়ে পুরুলিয়া জেলার জন্ম দেওয়া হয়। বাঙালি আজকে সেই দিনগুলোর কথা ভুলে গেছে। এ প্রজন্মের অনেকেই পুরুলিয়া বঙ্গভুক্তি দিবসের কথা জানেন না। আমাদের কর্তব্য এই বিষয়গুলো বাঙালিকে বারংবার স্মরণ করানো।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment