Header Ads

কেবল বাঁকুড়ায় নয়, হুগলিতেও আছে টেরাকোটা গ্রাম, নাম তার 'দশঘরা'


আমরা সকলেই জানি, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে অনেক টেরাকোটার মন্দির আছে। কিন্তু কেবল বিষ্ণুপুরেই নয়, বাংলার নানান জায়গার মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে টেরাকোটার নিদর্শন। বিষ্ণুপুরের মতো হুগলির দশঘরাতে অনেক টেরাকোটার নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় যে কারণে দশঘরাকে টেরাকোটার গ্রাম বলা হয়। হুগলি জেলার ধনিয়াখালী থানার অন্তর্গত একটি গ্রাম হলো দশঘরা। কথিত আছে, এই প্রত্যন্ত গ্রামটি একসময় সমৃদ্ধশালী বারোদুয়ারী রাজ্যের রাজধানী ছিল৷ 


সুধীরকুমার মিত্র তাঁর "হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ" গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছেন -- "পাল বংশীয় এক কায়স্থ নরপতি দশঘরার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন বলে রজনীকান্ত রায় লিখেছেন। কিন্তু এই রাজবংশের কথা কোনো ইতিহাসে নেই। মেদিনীপুর জেলার ধারেন্দা রাজবংশের পূর্বপুরুষ নারায়নচন্দ্র পালচৌধুরী মুঘলদের অত্যাচারে দশঘরা ত্যাগ করে মেদিনীপুরে জমিদারি সনদ গ্রহণ করেন। দশটি ছোট ছোট গ্রাম নিয়ে গঠিত হয়েছিল বলে এর নাম হয় দশঘরা৷ এই দশটি গ্রাম এখনও বর্তমান। গ্রামগুলি হলো শ্রীকৃষ্ণপুর, জাড়গ্রাম, দিঘরা, আগলাপুর, শ্রীরামপুর, ইচ্ছাপুর, গোপীনগর, গঙ্গেশনগর, পারাম্বো ও নলথোবা। দশঘরা বলে একটি পৃথক মৌজা থাকলেও সরকারি গ্রন্থে উল্লেখিত একটি গ্রামকেই দশঘরা বলা হয়।"

মুঘল আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাজারা মহামূল্যবান মোহর রত্ন সামগ্রীগুলো দিঘির জলে লুকিয়ে রাখতো বলে এর নাম হয়েছে দশঘরা। মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে দশঘরা থেকে কিছু দূরে চকদিঘি গ্রামে অবস্থান করেছিলেন বলে জানা যায়। 


ঐতিহ্যময় মন্দিরের শহর দশঘরা। যাকে 'বাংলার বিষ্ণুপুর' বললেও হয়তো ভুল হবে না। এই গ্রামের সর্বত্র পুরাকীর্তির নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই গ্রামের বাইরে পাশাপাশি বেশ কিছু জায়গায় পুরাকীর্তির চিত্র দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলো হলো - আঁটপুর, দ্বারহাট্টা, রাজবলহাট, ভাঙামোড়া, ভান্ডারহাটি, বৈকুণ্ঠপুর, সোয়ালুক ও দেউলপাড়া। এই গ্রামে সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায় বিশ্বাস পাড়ায় গোপীনাথ মন্দির, রাসমঞ্চ, দোলমঞ্চ, চন্ডীমণ্ডপ, শিবমন্দির, নহবতখানা, গোপীসাগর, কাছারি বাড়ি, বিশালক্ষী জোড়বাংলা মন্দির এবং রায় পাড়ার শিবমন্দির, ঘড়ির টাওয়ার, বড় খিলান গেট, রায় বাড়ির নাচঘর, সিংহ দুয়ার, ব্রাডলি বার্ট বাংলো, বিপিনকৃষ্ণ রায়ের ম্যানশন বাগান ও চ্যারিটেবল ডিসপেনশনারী৷ 


দশঘরা জায়গাটি প্রাচীনকালে প্রসিদ্ধ ছিল এবং জায়গাটির যথেষ্ট ঐতিহাসিক  গুরুত্ব রয়েছে। ইতিহাস অনুযায়ী উৎকলনিবাসী জনৈক জগমোহন বিশ্বাস দশঘরাতে বিশ্বাস বংশের প্রতিষ্ঠা করেন ও এই গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এঁদেরই প্রতিষ্ঠিত গোপীসায়র দীঘি ও জমিদারদের কাছারি বাড়ি, দুর্গা দালান, পঞ্চরত্ন গোপীনাথ মন্দির, চারচালা দোলমঞ্চ, অষ্ট কোণাকৃতি রাসমঞ্চ, আটচালা শিব মন্দির। শিবমন্দিরের পিছনে যে বাড়িটা আছে সেটি ছিল নহবৎখানা এবং সিংহ দুয়ার দিয়ে ঢুকেই ডানদিকের প্রথম বাড়িটি জমিদারদের বৈঠকখানা। স্থানীয়দের কাছে এটি সাঘর বলে পরিচিত৷ সম্ভবত জলসাঘরের অপভ্রংশ।   

দশঘরার প্রতিটি নিদর্শন টেরাকোটার অপরূপ সাজে সজ্জিত। প্রতিটি নিদর্শনের শৈল্পিক কারুকার্য খাজুরাহোর ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্যকেও হার মানায়। এখানকার মন্দিরগুলো ৩০০ থেকে ৪০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন। হাওড়া বর্ধমান কর্ড লাইনের গুড়াপ অথবা তারকেশ্বর স্টেশনে নেমে বাসে বা ট্রেকারে চেপে এখানে পৌঁছানো যায়। একদা তারকেশ্বর-জামালপুর ছোট লাইনের ট্রেন দশঘরা ও চকদীঘি স্টেশনে থামত৷ 

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments