Header Ads

কুস্তিতে ভারতের প্রথম বিশ্বজয় হয় বঙ্গসন্তান 'দ্য জেন্টল জায়ান্ট' গোবর গোহের হাত ধরে


কুস্তিতে কোনও ভারতীয়ের সেই প্রথম বিশ্বজয় এক বঙ্গসন্তানের হাত ধরে, ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের বেশ অনেকগুলি বছর আগে৷ 'দ্য জেন্টল জায়ান্ট' গোবর গোহ ১৯২১ সালে সানফ্রান্সিসকোতে তৎকালীন লাইট হেভিওয়েট রেসলিং চ্যাম্পিয়ন অ্যাড স্যান্টেলকে যেদিন গোহারা হারিয়ে পদক জিতলেন সেই দিনটি সত্যিই ছিল ভীরু, দুর্বল অপবাদ ঘুচিয়ে সাহেবদের দেশে পরাধীন দেশের এক বাঙালি ভারতীয়র জয়যাত্রা।


সত্যি বলতে কি জীবিত অবস্থায় কিংবদন্তি হওয়ার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন গোবর গোহ৷ পিতৃদেব রামাচরণ বলতেন ঈশ্বরের দেওয়া শরীরটা অযত্ন করো না, প্রাণপণ সাধনা করো, ফলাফল তিনিই দেবেন৷ গোবর গোহ কে কিংবদন্তি গড়ে দিয়েছিল যে-সব লড়াই, তার প্রায় সবই সে কালের সেরা মার্কিন ও ইউরোপের কুস্তিগীরদের সঙ্গে লড়ে। জীবনের দশ-দশটা বছর তিনি বিদেশে লড়ে কাটিয়েছিলেন, যার শুরু ১৯১০-এ, বয়স যখন নিতান্ত আঠারো।

আসল নাম ছিল যতীন্দ্রচরণ গুহ, তবে ডাক নামেই তিনি বিশ্ববিখ্যাত পালোয়ান, পিতামহ অম্বিকাচরণ গুহ ছিলেন বিখ্যাত কুস্তিগীর, তিনিও কুস্তিতে দেশে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, বেশ ধনী মানুষ ছিলেন, বলা যায় পারিবারিক কুস্তির ধারা বজায় রাখতে অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছেন, মথুরা থেকে বীর হনুমানের এক পাথরের মূর্তি আনিয়ে ৬৫ মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে আখড়া বসালেন শিবচরণ, আর ওই মথুরারই বড় পালোয়ান কালী চৌবেকে আখড়ার গুরু করলেন সবই অম্বিকাচরণের উৎসাহে, উদ্দেশ্য ছিল শরীর চর্চার মাধ্যমে দেশের মানুষকে সজীব ও সতেজ করে তোলা৷ গোবর গোহের কাকা ক্ষেত্রচরণ গুহ যৌবনে ভারত বিখ্যাত কুস্তিগীর হয়েছিলেন, কলকাতায় তাঁর আখড়ায় ছিল বিখ্যাত কুস্তিগীরদের আড্ডা৷ গোবরের যখন ১৩ বছর বয়স তখন ক্ষেত্রচরণ প্রয়াত হলেন, কুস্তির চর্চা, বংশের মর্যাদা কে ধরে রাখবে? কাকা ক্ষেত্রমোহনের আকস্মিক মৃত্যুর পর অনেক ঝড়ঝাপটা সামলাতে হল বালক গোবরকে, তবে সহায় হয়েছিলেন যতীন্দ্রচরণের জামাইবাবু শরৎকুমার মিত্র, তাঁর অনুরোধে গোবর গিয়ে পৌঁছলেন লাহোরে। তখন গুলাম মহম্মদ বক্শ যাঁকে 'দ্য গ্রেট গামা' বলা হত, তাঁর সঙ্গে কুস্তির ম্যাচ ছিল আর এক ভারতবিখ্যাত পালোয়ান রহিম সুলতানিওয়ালার। সেই ম্যাচ চাক্ষুষ করার জন্য সে সময় সারা দেশের বহু মানুষ লাহোর পৌঁছেছিলেন।

যতীন্দ্রচরণ একটা স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নটা ছিল এই গামা, সুলতানিওয়ালাদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্বজয়ের।তারপরের ঘটনায় যে গৌরবের ইতিহাস তৈরি হয়েছে সেই কাহিনী আর নতুন করে বলার কিছুই নেই৷ সদ্য খেতাব হারিয়েছেন মার্কিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এড 'স্ট্র্যাংগলার' লুইস, তাঁর সঙ্গে লড়বেন গোবর,মার্কিন দেশে সেই নিয়ে তুমুল উত্তেজনা৷ কিন্তু লড়াই জমল কোথায়, লুইসকে এক ঘণ্টার মধ্যে গোবর আছড়ে ফেললেন রিংয়ে আগ্রাসী গোবরের কাছে দাঁড়াতেই পারলেন না 'স্ট্র্যাংগলার' লুইস৷ আবার যিনি কয়েক মাস আগে লুইসকে কাত করে বিশ্ব খেতাব জিতে নিয়েছিলেন সেই সিবিস্কো, তিনিও হেরেছেন গোবর গোহের কাছে৷ শুধু সিবিস্কো কেন আমেরিকায় শ্রেষ্ঠ পালোয়ানদের তিনি হারিয়েছেন হেলায়, সেই তালিকায় আছেন জো স্টেচারের মত কুস্তিগীর৷ 

আমেরিকার মাটিতে হল্যান্ডের চ্যাম্পিয়ন পালোয়ান টমি ড্রুককে প্রায় হারিয়ে দিয়েছিলেন গোবর গোহ, লড়াইয়ের শুরু থেকে তাঁর প্রাধান্য, ড্রুক শত চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেন নি, বরং জয় গোবরেরই নিশ্চিত ছিল, যদি না রেফারি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব করতেন,সত্যি বলতে কি কুস্তি অথবা বক্সিংয়ের ক্ষেত্রে এই রোগটা বোধহয় আজও নিরাময় করা সম্ভব হয় নি!

বিদেশে তাঁর সাফল্য শুরু এইসবের অনেক আগে, স্কটল্যান্ডের মস্ত পালোয়ান জিমি ক্যাম্বেল কুস্তিতে হেরে গিয়েছিলেন গোবর গোহের কাছে, জিমি এসেন কে হারিয়ে তিনি জিতেছিলেন চ্যাম্পিয়নশিপ অফ ইউনাইটেড কিংডম৷ যদিও চ্যাম্পিয়নের প্রাপ্য 'জন বুল বেল্ট' তাঁকে দেওয়া হল না, কারণ তিনি 'যদিও ব্রিটিশ প্রজা, কিন্তু জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নন'।

প্যারিসে গোবর গোহের বিজয়রথ যেন অশ্বমেধের ঘোড়া, ইউরোপের বড় বড় পালোয়ানদের সঙ্গে তিনি লড়েছেন আর জিতেছেন, বেলজিয়ামের হ্যানসন আর জার্মানির কার্ল জাফট-কে অবলীলায় হারিয়ে দিয়েছেন৷ রোজ ছ'ঘণ্টা ডন-কুস্তি করেও গোবর গোহ ক্লান্তি বলে বস্তুর সাথে সাক্ষাৎ পেতেন না দু'আড়াই হাজার বৈঠকেও কিছু হয় না। তাই গলায় একটা ১৬০ পাউন্ড ওজনের পাথরের হাঁসুলি পরতে হয়। তখন তাঁর দু'জোড়া মুগুরের এক জোড়ার প্রতিটির ওজন ২৫ সের। অন্য জোড়ার প্রত্যেকটার ওজন এক মণ দশ সের করে। ১৯২১ সালে স্যান্ডো গেঞ্জি আর শর্টস পরে আমেরিকায় তোলা কুস্তির পোজের ছবি, কার্যত গোবর গোহ বলতে যে ছবি সবার চোখে ভাসে, ভারী দশাসই সেই চেহারা, কেমন? বর্ণনা একটু শুনতেই হয়৷ ছ’ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার ঊনত্রিশ বছর বয়সের দৈত্যাকার গোবরবাবুর ওজন তখন ২৩০ পাউন্ড। গলা ২০ ইঞ্চি, হাতের গোছা ১৫ ইঞ্চি, কব্জি পৌনে ৯ ইঞ্চি, বুক ৫০ ইঞ্চি, বুক (ফোলালে) ৫২ ইঞ্চি, ঊরু ৩৩ ইঞ্চি, পায়ের ডিম সাড়ে ১৮ ইঞ্চি৷

১৯২৯ সালে পার্ক সার্কাসে কংগ্রেসের অধিবেশনের কুস্তি প্রদর্শনীতে গোবর গোহর প্রতিপক্ষ ছিলেন ছোট গামা। ছোট গামা পরপর দু’বার ফাউল করা সত্ত্বেও তাঁকেই বিজয়ী ঘোষণা করেছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব সেই ঘটনায় অবাক হয়েছিলেন বেশিরভাগ মানুষ৷ ছোট লামার সাথে কুস্তি আর  কুস্তির ফল নিয়ে  'দ্য জেন্টল জায়ান্ট' গোবর গোহের সামগ্রিক মূল্যায়ন করা একপ্রকার বোকামি, কারণ গোবর গোহ হারিয়েছেন বিশ্বের সেই সময়ের সেরা কুস্তিগীরদের৷

প্রথম ভারতীয়, প্রথম বাঙালি হিসেবে কুস্তিতে বিশ্বজয় করলেও আমরা কতজন মনে রেখেছি গোবর গোহের কথা!

তথ্যসূত্র- নির্বাচিত জীবনী সমগ্র; নচিকেতা ঘোষ, আনন্দবাজার পত্রিকা।

প্রতিবেদন- অরুণাভ সেন


No comments