হাওড়ার হাওড় কী আজ সত্যিই বিপন্ন?
"হাওড়া" নামটির উৎপত্তি "হাওড়" শব্দটি থেকে; যার অর্থ "যেখানে পাঁক ও কাদা বেশি হয়" কিন্তু হাওড়ার হাওড় আজ বিপন্ন। এই হাওড়ার ডুমুরজলা মূলত রাজ্যের অন্যতম জলাভূমির মতোই একটি বড় জলাভূমি যা এখন কালের অন্তরালে শহর হাওড়ার অন্যতম খেলার মাঠ হিসেবে পরিচিত। যা হাওড়া শহরের অন্যতম বাস্তুতন্ত্রের ধারক ও বাহক, অনেক টা ফুসফুসের মতোই। প্রাকৃতিক নিয়মেই অসংখ্য বৃক্ষ, গুল্ম, লতা, বিভিন্ন প্রজাতির জীব যেমন স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, উভচর, মেরুদণ্ডী, পাখি, পোকামাকড়ের বসবাস স্থল এটি। শিবপুর, মধ্য হাওড়া, দক্ষিণ ও উত্তর হাওড়া ছাড়াও বিভিন্ন জায়গার মানুষ এখানে আসেন সকাল, দুপুর ও বিকেলে।
সকালে প্রাতঃভ্রমন, সকাল-সন্ধ্যায় শরীরচর্চা, খেলাধূলা ও আড্ডার উপযুক্ত কেন্দ্রস্থল হলো ডুমুরজলার মাঠ। শহর হাওড়ার প্রাণকেন্দ্র হলো এই মাঠ। আট থেকে আশি সকল শ্রেণীর মানুষের বড্ড প্রিয় এই জায়গা। সকলেই প্রাণভরে আরামদায়ক মৃদুমন্দ বাতাস খেতে আসেন এখানে। এছাড়াও বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও ক্লাবের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয় এই মাঠে। ভৌগোলিক অবস্থানগত ভাবে ডুমুরজলা মাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রায় ৫৫ একর জমিজুড়ে বিস্তার লাভ করেছে এই মাঠ। হাওড়ার শহরের বুকে এরকম বৃহৎ মাঠ আর নেই বললেই চলে।
২০১১ সালে ভারতের কেন্দ্র সরকার সারা দেশের জলাভূমি অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয়। এই রাজ্যে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি কর্তৃপক্ষ (EKWMA) এই দায়িত্ব পালন করে, সেই উদ্যোগে এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলার উল্লেখযোগ্য জলাভূমি গুলোর মধ্যে ডুমুরজলাও ছিল। অর্থাৎ ডুমুরজলার বাস্তুতন্ত্রিক পরিচিতি এটি একটি জলাভূমি পরে সবুজ ভূমি ও শেষে ক্রীড়াভূমি। এই ৫৫ একর জমি কালের নিরিখে হস্তান্তরিত হয়ে হিডকোর কাছে এসেছে "খেল নগরী" প্রজেক্টের জন্য।খেলা থেকেই খেল নগরী। খেলা মানে শুধুই খেলা, আর তার জন্যই দরকার মাঠ।বর্তমানে এই জমিটির চরিত্র বদলে যাবে এই প্রজেক্ট করার মাধ্যমে।
হাওড়া জেলার পরিবেশ বিশেষজ্ঞ থেকে পরিবেশ বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মীরা জানাচ্ছেন, ডুমুরজলা না থাকলে হাওড়া শহর বন্যায় ভেসে যাবে। পরিযায়ী পাখিদের আসাযাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। হাজার হাজার ছেলেমেয়েরা খেলাধূলা ও শরীরচর্চা করার নির্দিষ্ট জায়গা পাবে না। সহস্র বৃদ্ধ-বনীতা মুক্ত বাতাস, ঘাস-মাটিতে হাঁটা থেকে বঞ্চিত হবেন। হাওড়া শহরের মানুষের শ্বাসকষ্ট জনিত রোগের পরিমাণ বেড়ে যাবে। খেলার সাথে জড়িত কয়েকশো মানুষের কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাবে। হাওড়া শহরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে। এমনকি আড্ডার পরিবেশ চিরতরে হারিয়ে যাবে।
এই ডুমুরজলার মাঠকে বাঁচানোর জন্য হাওড়া জেলার বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠন থেকে সামাজিক সংগঠনগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেভ ডুমুরজলা নামে একটি জয়েন্ট ফোরাম তৈরি করেছেন৷ তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন- এই প্রজেক্টের মাধ্যমে উন্নয়নের যে ধারা শহর হাওড়ার আর্থসামাজিক পরিকাঠামোর যে আমূল পরিবর্তন ঘটাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু সেই উন্নয়ন কি বহনীয় উন্নয়ন বা Sustainable Development হবে?
সেভ ডুমুরজলা জয়েন্ট ফোরাম তুলে ধরেছেন একটি ভয়াবহ রিপোর্টও। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব IPCC (ইন্টার গভনমেন্টাল প্যানেল ক্লাইমেট চেঞ্জ) সাম্প্রতিক রিপোর্টে ভয়াবহ পরিণতির কথা উঠে এসেছে, তাতে আগামী দশ বছরেই ভারতের প্রধান শহরের বিভিন্ন উপকূলীয় স্থান জলের তলায় চলে যাবে বলে ঈঙ্গিত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়াও কাউন্সিল অফ এনার্জি ও এনভায়রমেন্ট এন্ড ওয়েদার (CEEW) জানিয়েছে, ভারতের প্রতি চার জেলার মধ্যে তিনটিই প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এবং অতি সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের পরিবেশ সংস্থা আইকিউ এয়ার যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে বিশ্বের বায়ুদূষণে কলকাতার স্থান চতুর্থ। সুতরাং, এই সব ভয়াবহ তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের আরো পরিবেশ প্রকৃতি বান্ধব হয়ে উঠতে হবে। ঠিক এখানেই ডুমুরজলার প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ডুমুরজলার মাঠ বাঁচানোর মর্মে গত ২০ শে নভেম্বর শনিবার সকাল সাড়ে সাতটায় ডুমুরজলা বাস্কেটবল কোর্টে একটি গণকনভেনশের আয়োজন করা হয়। যেখানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী সব্যসাচী চ্যাটার্জি, ইমতিয়াজ আহমেদ, পরিবেশ কর্মী শঙ্কর মুখার্জি, সম্রাট মন্ডল, অনিমেষ দত্ত, শ্রাবনী চৌধুরী, ফুটবলার রঞ্জন দে, হাওড়া বাংলা পক্ষের সম্পাদক জয়দীপ দে, সেভ ডুমুরজলা জয়েন্ট ফোরামের সম্পাদক বলরাম ছরি এবং ফোরাম এর সদস্য ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গরা।
পরিবেশ কর্মীরা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে জানিয়েছেন, যে ডুমুরজলার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে তারা আইনি সহায়তা নেবেন। এ রাজ্যের সচেতন পরিবেশ সংরক্ষক, পরিবেশ প্রেমী ও কর্মীরা কখনোই সমাজের শত্রু নয়। তারা কখনোই সরকার বিরোধী বা উন্নয়ন বিরোধী নয়।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
তথ্য স্বীকার- সম্রাট মন্ডল
Post a Comment