বাংলায় দীপাবলিতে যেভাবে সূচনা হয় কালীপুজোর
দীপাবলির সূচনা হয়েছিল বর্ষান্তে কীটের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য। কীটের উপদ্রবে হৈমন্তিক ফসল নষ্ট না হয়ে যায় তার জন্য কার্ত্তিক মাসে বিশেষ করে কার্ত্তিকী অমাবস্যার দিন এক সঙ্গে অনেক দীপ জ্বালিয়ে কীট নির্মূল করার জন্য মানুষ এটা প্রচলন করেছিল।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের পর যখন বাংলায় পূর্ব ভারতে তন্ত্রের স্রোত বইতে শুরু করল তখন তারা তন্ত্রসাধনার শ্রেষ্ঠ রাত হিসেবে এই কার্ত্তিকী অমাবস্যাকে বেছে নিয়েছিল। গোটা বছরের সব চেয়ে অন্ধকার হচ্ছে এই কার্ত্তিকী অমাবস্যা। তান্ত্রিকরা বেশি অন্ধকারেই বৌদ্ধ যুগে বৌদ্ধ দেবী কালিকার পুজা শুরু করেছিলেন। রাত্রি বারোটা থেকে তিনটের মধ্যে। বাংলার মানুষ বৌদ্ধ ধর্ম ছেড়ে দিয়েছে দীর্ঘকাল হল। বৌদ্ধতান্ত্রিক দেবী কালিকা আজ পৌরানিক তান্ত্রিক দেবী কালীতে রূপান্তরিতা হয়ে গেছেন। তবে সেই রাত্রির তৃতীয় প্রহরে পূজা করার প্রথা আজও বলবৎ আছে। বৌদ্ধ বিধিটা পালটে বাংলার মানুষ চালু করেছে নতুন সনাতনী বিধি।
বাংলায় কালীপূজা প্রবর্তন করেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তার প্রবর্তিত ব্যবস্থার আগে চলতো বাংলার পুরানো সামাজিক নিয়মকানুন। তিনিও এই সময় তিথি মেনে নিয়ে নতুন ভাবে কালীপূজা প্রবর্তন করেন। তবে একেবারে হুবহু বৌদ্ধ 'কালিকা' শব্দটা কি করে রাখেন। তাই দেবীর নামকরণ করেদিলেন শ্যামা। পাঁঞ্জিতে দেখা যায় শ্যামা পূজা। কিন্তু বলে কালীপূজা কারণ তাদের পূর্বপুরুষরা বৌদ্ধযুগে কালীপূজা বলত। কালীপূজার আগের দিনটার নাম কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ নরক চতুর্দশী করে দেন। এটা বৈষ্ণব শব্দ। বাংলায় ভূত চতুর্দশী।
একবার শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকার বাইরে ছিলেন। সেই সময় নরকাসুর নামে এক অনার্য সর্দার দ্বারকা আক্রমণ করেছিল। সেই সময় কৃষ্ণের প্রথমা মহিষী সত্যভামা স্ব-সৈনে তার মোকাবিলা করেছিল। যুদ্ধে নরকাসুরের মৃত্য হয়েছিল। সেদিন ছিল চতুর্দশী তিথি। এই নরক চতুর্দশী তিথিতে চৌদ্দটা প্রদীপ জ্বেলে উৎসব করেছিল আর পরের দিন অমবস্যাতে সত্যভামার পূজা করা হয়েছিল। সত্যভামাকেই মহালক্ষ্মী দেবী হিসাবে পূজা করা হয়। সেই কারনে পশ্চিম ভারতের লোকেরা নরক চতুর্দশী বলে, বাংলায় ভূত চতুর্দশী।
ভূত চতুর্দশীর দিন চৌদ্দটা প্রদীপ জ্বালানো হয়, এর অর্থ পরের দিন ভালো করে আলো জ্বালব, অন্ধকারে আলোকসম্পাত করবো। শস্য রক্ষার জন্য আকাশ প্রদীপ জ্বালা দীপাবলি করা এটা বাইরের আলো। বাইরের অন্ধকারকে যুঝতে মনের আলো দিয়ে। মনের প্রদীপ জ্বেলে। আসলে এর অন্তর্নিহিত অর্থ হল - চৌদ্দটা প্রদীপ জ্বালিয়ে ষড়রিপু অষ্ট পাশ কে দূর করা, নিজের ভাব লোকে আলোক উজ্জ্বল করা। এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে অমানিশায় যুঝবার জন্য সেকেলের মানুষ, বিশেষ করে বাংলার মানুষ আলোকসজ্জা করেছিল। ঘন ঘোর তমসার বিরুদ্ধে যুঝবার জন্য এই দীপাবলি। আজও তাই চলেছে। 'তমসো মা জ্যোতির্গময়'। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে চলো।
প্রতিবেদন- গৌতম মন্ডল
তথ্যসুত্রঃ- দীপাবলি-১,২,৩, বাংলা ও বাঙালী- প্রভাত রঞ্জন সরকার
Post a Comment