Header Ads

লন্ডন থেকে রাশিয়া তাঁর খ্যাতি সর্বত্র, চন্দননগরের আলোকসজ্জার পথপ্রদর্শক শ্রীধর দাস


উৎসবের মুহূর্তগুলো রঙিন করে তুলতে চন্দননগরের আলোকসজ্জার এক অনন্য ভূমিকা রয়েছে। বাংলার মানুষের কাছে রংবেরঙের আলোকসজ্জা মানেই চন্দননগর। যত দিন যাচ্ছে ততই চন্দননগরের আলোকসজ্জা আধুনিক থেকে আধুনিকতর হয়ে উঠছে। যে-কোনো পুজো পার্বণ কিংবা মেলা চন্দননগরের আলোকসজ্জা ছাড়া অসম্পূর্ণ। আমরা দুর্গাপুজো থেকে জগদ্ধাত্রী পুজোতে চন্দননগরের আলোকসজ্জার মহিমায় মুগ্ধ হয়ে উঠি। চন্দননগরের আলোকসজ্জার এক বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে। বাংলার সীমানা পেরিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর দেশেও আজকে পৌঁছে গেছে চন্দননগরের আলোকসজ্জা। যার পথপ্রদর্শক হলেন কিংবদন্তি আলোকশিল্পী শ্রীধর দাস। 

ছবিটি সিটিলাইটস অফ মৌ ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেওয়া    

পৃথিবীর নানা জায়গায় বাঙালির প্রসঙ্গ উঠলেই যে কথাগুলো বেশি করে বলা হয় তা হলো বাঙালিরা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রিয় জাতি। তবুও বাঙালিরা ভুলে গেছে বহু কৃতি বাঙালির অবদানকে। বর্তমান বাঙালি প্রজন্ম ভুলে যাচ্ছে তার জাতির নানান ইতিহাস। বহিরাগত সংস্কৃতি আজকে বাঙালিকে গ্রাস করছে। একটা জাতির মেরুদণ্ড হলো তার মজবুত ইতিহাস। কিন্তু সেই ইতিহাসের এক একটা ইট যখন খসে পড়তে থাকে তখন একটা জাতি অধঃপতনের দিকে ক্রমশ ধাবমান হয়। অতএব বাঙালিকে তার ইতিহাস ও কৃষ্টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে। 

ভাবতে অবাক লাগে শ্রীধর দাসের মতো একজন আলোকশিল্পী যার বিশ্বজুড়ে বিশাল একটা পরিসর রয়েছে। চন্দননগরের মতো অভূতপূর্ব আলোকসজ্জার যিনি প্রাণপুরুষ। তাঁকে নিয়ে খুব একটা বেশি চর্চাও হচ্ছে না। বাঙালির মতো একটি সিভিলাইজড জাতি কী করে ভুলতে পারে তার নিজের লোক শ্রীধর দাসের মতো মহান ব্যক্তিত্বকে? এখানেই একটা সংশয় থেকে যায়৷ শ্রীধর দাসকে নিয়ে এখন আপনারা যে প্রতিবেদনটি পড়ছেন আপনাদের দায়িত্ব এটা লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।  

চন্দননগরের আলোর রোশনাই শ্রীধর বাবুর হাত ধরে ভারত থেকে রাশিয়া হয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছে। গোটা বাংলার মানুষ তাঁকে মনে না রাখলেও চন্দননগরের মানুষ তাঁকে মনে রেখেছেন। তাঁর খ্যাতি টের পাওয়া যাবে চন্দননগর স্টেশনে নামলেই। পথচলতি মানুষ হোক বা দোকানদার, অটো-টোটো ও রিকশাওয়ালা সকলেই চেনেন চন্দননগরের আলোর পথপ্রদর্শকের বাড়ি। ১৯৫৬ সালে স্কুলজীবনের গণ্ডি পেরনোর আগে থেকেই আলোর জগতে হাতেখড়ি হয় শ্রীধরবাবুর। তারপর তাঁকে আর বারেক ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক জয়ের মাইল ফলক পার হয়ে এসেছেন তিনি।   

শ্রীধরবাবুর বয়স তখন সবে তেরো বছর। তিনি সপ্তম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছেন। সে বছর হতেই সর্বসমক্ষে খ্যাতির সূচনা হলো তাঁর। নাড়ুয়া শিক্ষা নিকেতনের সরস্বতী পুজোতে তিনি আলোকসজ্জার দায়িত্ব পান।    যে দায়িত্ব তিনি স্বযত্নে লালন করেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাঁকে কাজের যৌতুক হিসেবে  দশ টাকা দেন। এই অল্প টাকাতেই তিনি যা করেছিলেন  তাতেই বিস্ময় তৈরি হয়েছিল সারা স্কুল জুড়ে। একটি বার্লির কৌটো কেটে তিনটি বাল্ব লাগিয়েছিলেন। যে বাল্ব তিনটি টিমটিম করে নানান রঙ পরিবর্তন করে জ্বলছে এবং নিভছে। এই আলোকসজ্জা এর আগে চন্দননগরের কোনো মানুষ দেখেননি৷ এই ঘটনার মধ্য দিয়েই শ্রীধরবাবুর চন্দননগরের আলোকসজ্জার পথপ্রদর্শক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার সহজ রাস্তা তৈরি হয়ে যায়।    

প্রথম আলোকসজ্জার দায়িত্ব পালনের দুই বছর পর তিনি তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে অটোমেটিক লাইটিং-এর কাজ আরম্ভ করেন। নাড়ুয়া শিক্ষা নিকেতনের সরস্বতী পুজোতে স্কুলের সামনের রাস্তায় এক অবাক করা লাইটিং লাগিয়ে দেন তিনি। লোকেরা দেখতে পান রঙিন আলোগুলো এদিক থেকে ওদিক ছোটাছুটি করছে। এমন নজরকাড়া আলোকসজ্জা দেখে চন্দননগর ও অন্যান্য জায়গার মানুষও তাঁর খোঁজ নিতে শুরু করেন। অল্প সময়েই তাঁর কাজ বাংলা জুড়ে বিস্তার লাভ করে। বোরোলীনের মতো নামীদামী সব কোম্পানি তাঁর কাছ থেকে আলোকসজ্জার বরাত নিতে থাকে। 

শ্রীধরবাবুর খ্যাতি অর্জনে নানান বাঁধাও এসেছে, যেমন কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার তাঁকে এ কাজ বন্ধ করতে বলেন। তাঁদের দাবি ছিল এই আলোকসজ্জাগুলো নাকি সব বিপজ্জনক। পরবর্তীকালে হাতে-কলমে পর্যবেক্ষণ করে তিনি দেখিয়ে দেন যে এই আলোকসজ্জাগুলো এতটুকুও বিপজ্জনক নয়৷ তারপর ফাটাকেষ্টর কালী পুজোতে আলোকসজ্জার দায়িত্ব পেলেন তিনি। পরের বছর কলেজ স্কোয়ারের দুর্গাপুজোতে আলোকসজ্জার মাধ্যমে সারা বাংলাকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। এরপর এতো পরিমাণে আলোকসজ্জার বরাত আসতে থাকে যে কিছু কিছু বরাত বাতিলও করতে হচ্ছে তাঁকে।   

তাঁর আলোকসজ্জার জনপ্রিয়তার খাতিরে তিনি জন্ম দেন এস ডি ইলেকট্রিক নামক একটি লাইট সংস্থার। মাদার টেরিজা থেকে সত্যজিৎ রায়, কন্যাশ্রী থেকে ২০১৭-তে ভারতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ, বিভিন্ন পুরানো ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তাঁর আলোয় উঠে এসেছে। তাঁর আলোকসজ্জাতে বারংবার উচ্চ মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে আসতে পারে এমন আলোকসজ্জা তিনি কখনো বানাননি। 

শ্রীধরবাবুর শিল্পসত্বা বাংলা তথা ভারতের নানান প্রান্ত এবং মালয়েশিয়া, রাশিয়া ও লন্ডন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। কলকাতার সেরা দুর্গাপুজোগুলোর মধ্যে পড়ে সিংহী পার্ক, একডালিয়া এভারগ্রীন, কলেজ স্কোয়ার, মহম্মদ আলি পার্ক ইত্যাদি। শহরের বিখ্যাত কালীপুজো বলতে ফাটাকেষ্ট বা সৌমেন মিত্রর পুজো। এই সমস্ত পুজোকে আলোকিত করে তোলার গুরুদায়িত্ব দীর্ঘদিন সামলেছেন শ্রীধরবাবু। 

চন্দননগরের আলোকসজ্জার পথপ্রদর্শক শ্রীধরবাবুর বয়স এখন ৭৬ বছর। তাঁর শরীরে আর আগের মতো আলোকসজ্জা বানানোর শক্তি নেই। আলোকসজ্জার কাজ থেকে বহুদিন হলো তিনি অব্যাহতি নিয়েছেন। প্রতিটি সচেতন বাঙালির উচিৎ শ্রীধরবাবুর অবদানকে ইতিহাসের পাতায় যত্ন সহকারে লিপিবদ্ধ করা। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments