বাংলা ও বাঙালির প্রকৃত ইতিহাস চিনিয়েও উপেক্ষিত দীনেশচন্দ্র সেন
বাংলা ও বাঙালির প্রকৃত ইতিহাস আমরা যার বইয়ের মাধ্যমে জানতে পারি তিনি হলেন দীনেশচন্দ্র সেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় বাঙালির কাছেই তিনি উপেক্ষিত থেকে গেছেন। দীনেশচন্দ্র সেনকে নিয়ে বৃহৎ পরিসরে কখনো কোনো আলোচনার উদ্যোগ বাংলার কোথাও চোখে পড়েনি। দীনেশচন্দ্রের আগে বাঙালির সমাজ ও ইতিহাসকে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা ও অনুসন্ধান তেমন কেউ করেননি, বিশ্লেষণ করেননি, অমন সুললিত ভাষায় লেখেননি৷ তাই বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির আলোচনায় সেদিন যেমন দীনেশচন্দ্র সেন অপরিহার্য ছিলেন, তেমনি আজও অপরিহার্য রয়ে গেছেন।
বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস রচনার জগতে অন্যতম বিখ্যাত ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সেন। ভারতীয় উপমহাদেশের লোকসংস্কৃতি বিষয়েও তাঁর গভীর গবেষণা সর্বজনবিদিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, অধ্যাপক এবং রামতনু লাহিড়ী গবেষক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব অপরিমেয়। লোকসাহিত্যের অপর এক সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে-র মাধ্যমে দীনেশচন্দ্র সেন সংকলন করেন 'মৈমনসিংহ-গীতিকা'র লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যের লোকগানগুলি। অতীতের বাঙালির লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার করার এই প্রয়াস তাঁকে বাঙালি বোদ্ধামহলে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
দীনেশচন্দ্র সেন বাংলা ও বাঙালির এমন কিছু অজানা ইতিহাস তুলে আনেন যা পড়লে বাঙালি সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের ধারণা বদলে যেতে পারে৷ উনবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে বাংলা ও বাঙালি সম্পর্কে যে তথ্য তিনি লেখনীর মাধ্যমে দিয়ে গেছেন তা ইন্টারনেট ঘাঁটলেও পাওয়া যাবে না। সেকেলে না ছিল কোনো ইন্টারনেট, না ছিল কোনো এনসাইক্লোপিডিয়া তারপরও তিনি বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস নিয়ে যা যা বই লিখেছেন তা সত্যিই অবিস্মরণীয় কীর্তি। আজকাল ইন্টারনেটের যুগ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়া সত্বেও বাংলা ও বাঙালির সঠিক ইতিহাস নিয়ে বই লেখার কাজ বেশিরভাগ বাঙালি লেখকই সেভাবে করছেন না। এখনকার কয়েকজন লেখকের মধ্যে যে সমস্যাটা বেশি করে দেখা দিচ্ছে তা হলো বাঙালিকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে লেখা। যা বাঙালি জাতিকে প্রায় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। দীনেশচন্দ্র সেন কখনো বাঙালিকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করেননি। তিনি বাঙালিকে জাতিগত পরিচয় ও ধর্মীয় পরিচয়ের তফাৎ শিখিয়েছেন।
শৈশবকাল থেকেই দীনেশচন্দ্র সেন সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন। ১৮৯০ সালে কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ 'কুমার ভূপেন্দ্রসিংহ'। এটি একটি আখ্যান কাব্য। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি গভীর টান ছিল তাঁর। যে টান তাঁকে কবিবন্দনা ও অতীতের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। কুমিল্লায় অবস্থানকালে তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রাচীন বাংলার পুঁথি সংগ্রহ করেন। ব্যাপক শ্রমসাধ্য এ কাজে তিনি গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন ও দীর্ঘ সময়ের গবেষণায় কুমিল্লা থেকে ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' শীর্ষক একটি আকরগ্রন্থ। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ওপর এটি একটি সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণাগ্রন্থ যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ সমকালের পন্ডিতদের প্রশংসা লাভ করে। এ অসাধারণ গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় দীনেশচন্দ্র সেন এ বিষয়ে পথিকৃৎ-এর সম্মান ও পান্ডিত্যের স্বীকৃতি লাভ করেন। এই বইটির ইংরেজি অনুবাদ 'হিস্ট্র অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার' তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকীর্তি।
বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস বিষয়ে তিনি লেখেন আরো কতগুলো আকর গ্রন্থ 'বৃহৎ বঙ্গ', 'বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়' ইত্যাদি। এছাড়াও ইংরেজি ভাষায় তিনি লিখেছেন অজস্র গবেষণামূলক বই যার মধ্যে 'দ্য ফোক লিটারেচার অফ বেঙ্গল', 'চৈতন্য অ্যান্ড হিজ কম্প্যানিয়নস', 'দ্য বৈষ্ণব লিটারেচার অফ মিডায়েভাল বেঙ্গল' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য৷ তাঁর লেখা আত্মজীবনী 'ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য' প্রকাশ পায় ১৯২২ সালে।
দীনেশচন্দ্র সেনের কাছে বাঙালি কতটা ঋণী সেটা বোধহয় আবার স্মরণ করার সময় এসেছে। তিনি যখন সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র, তখন একটা নোটবুকে লিখেছিলেন, "বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হইব, যদি না পারি ঐতিহাসিক হইব। যদি কবি হওয়া প্রতিভায় না কুলায়, তবে ঐতিহাসিকের পরিশ্রমলব্ধ প্রতিষ্ঠা হইতে আমায় বঞ্চিত করে, কার সাধ্য?" তিনি কবি হতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু পথিকৃৎ সাহিত্য-ইতিহাসবিদদের যে ভূমিকা তিনি নিয়েছিলেন তা চিরস্থায়ী স্বীকৃতি পেয়েছে।
তথ্যসূত্র- 'ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য'; দীনেশচন্দ্র সেন, বাংলাপিডিয়া, সববাংলায় ডট কম
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment