বাস কন্ডাক্টরি করে চিরাচরিত নজির ভাঙছেন বঙ্গনারী সাগরিকা পল্লবী
পেশাতে কোনো লিঙ্গভেদ হয়না। নারী হোক বা পুরুষ যে-কোনো কাজই সবার৷ বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে নারীরাও সবরকম পেশাতে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন। বছর তিরিশের বাঙালি গৃহবধূ সাগরিকা পল্লবী, যিনি দূরপাল্লার একটি বাসের কন্ডাক্টর হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার টাউন চন্দ্রকোনা শহরের মানুষের মন জয় করছেন। হাবড়ার বাসিন্দা সাগরিকা দেবী বহুদূর পড়াশোনা করেও কোনো চাকরি পাননি। তার স্বপ্ন ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানো। তাই শেষমেশ পেশা হিসেবে বাস কন্ডাক্টরিকেই বেছে নেন তিনি।
সাগরিকা দেবী একটি চন্দ্রকোনা টু কলকাতা দূরপাল্লার বাসের কন্ডাক্টর। প্রত্যহ নিজের দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি ভোর তিনটের সময় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন। তারপর তিনি বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হন। ভোর পাঁচটার সময় তার বাস চন্দ্রকোনা থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। বাসটি কলকাতায় পৌঁছায় সকাল নটায়। বাসস্ট্যান্ডে বাস পৌঁছানো মাত্রই তিনি টিকিট বিক্রির হিসেব গুণতে থাকেন। তারপর তিনি সেখানেই সেরে নেন লাঞ্চ। এরপর বাসস্ট্যান্ডের পাশে থাকা এক শিশু উদ্যানে কিছু বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সাথে সময় কাটান তিনি। ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক বারোর ঘরে তখন তিনি আবারো বাসে উঠে পড়েন। দুপুর বারোটা দশে কলকাতা থেকে বাসটি চন্দ্রকোনার দিকে রওনা দেয়। বিকেল চারটের সময় চন্দ্রকোনা পৌঁছায় বাসটি। এভাবেই বাসের সঙ্গেই প্রত্যেকটা দিন কাটছে তার।
শৈশব থেকেই অভাব তাদের পরিবারের নিত্যসঙ্গী। অভাবের সংসারে ছোটোবেলায় তার বাবা মারা যাওয়ার পর দুই বোন ও এক ভাইকে নিয়ে অসম লড়াই আরম্ভ করেন। টিউশন পড়িয়ে স্নাতক পাশ করার পরও তার মেলেনি কোনো চাকরি। যে কারণে হতাশায় বহুদিন যাবৎ কাটান তিনি। তবে জীবনে ব্যর্থতার ধাক্কা সামলাতে সামলাতে তার মধ্যে লড়াকু মানসিকতা তৈরি হয়। টিউশন পড়ানোর সাথে সাথেই সব্জী ব্যবসার কাজ শুরু করেন তিনি৷ কিন্তু তিনি আরো বড় কিছু করার জন্য উদ্বেল হয়ে ওঠেন।
বড় কিছু কাজ করার জন্য তিল তিল করে অর্থ জমাতে থাকেন তিনি৷ এরই মাঝেই ঘাটাল থানার নতুন গ্রামে বিয়ে হয় সাগরিকা দেবীর। বিয়ের পর তার হঠাৎ ইচ্ছে হয় একটি প্যাসেঞ্জার বাস কিনবেন। যদিও বাস কেনার মতো অর্থ তার না থাকার জন্য তিনি চন্দ্রকোনা থেকে কলকাতাগামী একটি যাত্রীবাহী বাসের লিজ নেন। তারপর থেকেই কন্ডাক্টর হিসেবে সেই বাসের টিকিট কাটার ব্যাগটি নিজের কাঁধে তুলে নেন। ভোর তিনটের সময় উঠে ঘাটাল থেকে চন্দ্রকোনা আসতে একটু সমস্যা হতে থাকে তার। কাজেই চন্দ্রকোনা বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটি বাড়ি ভাড়া নেন তিনি। সেখানেই বর্তমানে তিনি রাত কাটান।
বাসের কন্ডাক্টরি করার জন্য অসন্তুষ্ট তার বাপের বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ি দুই বাড়ির লোকেরাই। কেউ কেউ তাকে কন্ডাক্টরির কাজ করতে দেখে অবাক হন। কেউ কেউ তাকে নিয়ে গর্বও করেন। চন্দ্রকোনা শহরের পরিবহন ইউনিয়নের লোকেরা তাকে বিভিন্নভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। দশভুজার মতো তিনি যেভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করছেন যা নারীশক্তিকে নতুন করে বেঁচে থাকার মন্ত্র জোগায়।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment