বাংলা ওয়েব সিরিজে মাইলস্টোন তৈরি করলো বাঙালি ম্যাকবেথ 'মন্দার'
"কালের কোলে কপাল ফেরে কেউ রাজা, কেউ রাজার বাপ।" 'মন্দার' ওয়েব সিরিজটি দেখার পর বহুক্ষণ কানের মধ্যে এই সংলাপটা ভেসে আসবে। গত ১৯ শে নভেম্বর হইচইতে মুক্তি পেয়েছে নতুন বাংলা ওয়েব সিরিজ 'মন্দার'। শেক্সপিয়ারের লেখা জনপ্রিয় নাটক 'ম্যাকবেথ'-এর ছায়া অবলম্বনে তৈরি হয়েছে 'মন্দার'। এই ওয়েব সিরিজটির পোস্টার থেকে টিজার ও ট্রেলার রিলিজের সময় থেকেই দর্শকদের মধ্যে সিরিজটিকে ঘিরে আলাদা উন্মাদনা লক্ষ্য করা যায়। মন্দারকে ঘিরে দর্শকদের মনে যে প্রত্যাশা ছিল তা অনায়াসেই পূরণ করেছে এই ছবি।
ম্যাকবেথ চরিত্রটিকে নিয়ে বাঙালিদের বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। সেই দুর্বলতা থেকেই মন্দার দেখার ইচ্ছে জেগেছে অনেকের মধ্যে। গল্পের প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো ম্যাকবেথের ছায়া অবলম্বনে সিরিজটি বানানো হলেও মন্দার ম্যাকবেথের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মন্দার এখানে আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে বাঙালি ম্যাকবেথ। যার সাম্রাজ্যের নাম গেইলপুর৷ ডাইনির মন্ত্র ও স্ত্রীর উস্কানিতে রাজা হওয়ার লোভে হিংস্র হয়ে ওঠে মন্দার। একের পর এক খুন করে ক্ষমতা দখলের জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে মন্দার।
বাংলার ম্যাকবেথ মন্দারের সমস্ত চরিত্রগুলো রূপান্তরিত হয়েছে বাংলা নামে যেমন ম্যাকবেথ থেকে মন্দার, লেডি ম্যাকবেথ থেকে লাইলি, রাজা ডানকান থেকে ডাব্লু ভাই, ফ্লেয়ান্স থেকে ফনটুস, ব্যাঙ্কো থেকে বঙ্কা, ম্যালকম থেকে মঞ্চার, ম্যাকডাফ থেকে মুকাদ্দার মুখার্জি ইত্যাদি।
এই ওয়েব সিরিজের প্রত্যেকটি চরিত্রকে ডার্কভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। গল্পে প্রতিটি চরিত্রের খিদে প্রচণ্ড বেশি। সকলেই যেন ক্ষুদার্থ। চরিত্রগুলোর সাথে অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন একদম যথাযথ। মন্দারের চরিত্রে দেবাশীষ মন্ডলের অভিনয় দূর্দান্ত। তিনি দক্ষতার সাথে চরিত্রটিকে পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছেন। লাইলির চরিত্রে সোহিনী সরকারের অভিনয়ও মুগ্ধ করার মতো৷ এছাড়াও অন্যান্য চরিত্র যেমন ডাবলু ভাইয়ের চরিত্রে দেবেশ রায়চৌধুরী, বঙ্কার চরিত্রে শঙ্কর দেবনাথ, মঞ্চারের চরিত্রে দিগন্ত হালদার, ফনটুসের চরিত্রে কোরক সামন্ত এবং মদনের চরিত্রে লোকনাথ দের অভিনয় বেশ টানটান। মন্দারে আলাদা করে যে চরিত্রের কথা বলতে হয় তা হলো মুকাদ্দার মুখার্জির চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের অভিনয়। মজার ছলে একটু মেয়েলি স্বরে একেবারে অন্যভাবে চরিত্রটিকে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর কিছু সংলাপ মনে রাখার মতো যথা "ভেরি নাইস ক্যাট, মিউ", "ও মাংস, আই মিন চিকেন, লেগ পিস আছে তো?"
মন্দার ওয়েব সিরিজের সবচেয়ে বড়ো চমক হলো এই প্রথমবার পরিচালনায় হাত দিলেন অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য। প্রথম পরিচালনাতেই তিনি প্রমাণ করলেন তিনি কেবল পরিণত অভিনেতাই নয়, পরিচালকও বটে। মন্দারের পর তাঁর পরিচয় হিসেবে লেখা থাকবে নাট্যকার, অভিনেতা, গায়ক ও পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য। শুধুমাত্র প্রতিভা থাকলেই যে পরিচালনা করা যায় তা কিন্তু নয়, একটা লার্জ স্কেলের ওয়েব সিরিজ বা ছবি বানাতে গেলে অসীম ধৈর্য্য ও নিষ্ঠার প্রয়োজন সাথে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট। মন্দার একটি লার্জ স্কেলের ওয়েব সিরিজ।
পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য গল্প, চিত্রনাট্য, অভিনয়, আবহ, চিত্র নির্ধারণ প্রতিটি দিকই তিনি যত্ন সহকারে গুরুত্ব দিয়েছেন। মন্দার ওয়েব সিরিজের যে বিষয়গুলো প্রশংসা করার মতো তা হলো ব্যাকগ্রাউন্ডে আশি-নব্বই দশকের বাংলা গান ও বিগত এক দশকের মুক্তিপ্রাপ্ত কিছু বাংলা গানের ব্যবহার। গল্পে দুই রাক্ষস মজনু বুড়ি ও তার ছেলে পেদোর ধরা ধরা গলায় সংলাপ ও তাদের এক্সপ্রেসন অনেকটা গা ছমছমে। মজনু বুড়ির লাল মুখ, ভাঙ্গা ভাঙ্গা কালো দাঁত, হাতে বর্শা তার মাথায় একটি মাছ গাঁথা; এই লুক দেখলে শিশুরা ভয় পেয়ে যাবে। পেদো নামক চরিত্রটি ডার্ক কমেডির ঘরানায় নির্মাণ করা হয়েছে। পেদোর অপরিস্কার মুখ, পরনে একটি ছোটো পেন্টি, অর্ধনগ্ন শরীর ও খালি পায়ে সমুদ্র সৈকত ও জঙ্গলে বন্যজন্তুর মতো সারাক্ষণ দৌড়ে বেড়ায়৷ পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্র সৈকতের দৃশ্য তার সাথে ড্রোনের দারুণ ব্যবহারও চোখে পড়ার মতো। এছাড়াও সিরিজটির বিশেষত্ব হলো গল্পটি থ্রিলার হলেও হরর স্টাইলে চিত্রনাট্য তুলে ধরা হয়েছে। যেটা দেখতে পুরোপুরি আন্তর্জাতিকমানের লাগছে।
হইচই ওয়ার্ল্ড ক্লাসিকের প্রথম ওয়েব সিরিজ মন্দার অত্যন্ত জমজমাট। এমন কাজ বাংলাতে আরো বেশি বেশি করে প্রয়োজন। ভারতে ম্যাকবেথের ছায়া অবলম্বনে যতগুলো কাজ হয়েছে সেই সকল কাজকে গুণে গুণে একশোবার টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে মন্দার৷ যারা কাজের চাপে এখনও মন্দার দেখে উঠতে পারেন নি তাদের অবশ্যই বলা উচিৎ মন্দার দেখুন৷ বাংলাতে এমন কাজ এর আগে কখনো হয়নি৷
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment