বিস্মৃতির আড়ালে থাকা বিদ্যাসাগরের মাস্টারমশাই জয়গোপাল তর্কালঙ্কার
আমরা পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে তো সকলে চিনি, তাঁর জীবন ও কর্মের কথা, সমাজের প্রতি তাঁর বিশেষ অবদানগুলোর কথা আমরা সকলেই জানি। এই তো বছরখানেক আগে তাঁর দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী আমরা বেশ শ্রদ্ধাভরেই এই কোভিড মহামারীর মধ্যেই পালন করলাম। কিন্তু, আমরা কি জানি যে যখন আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০ তম জন্মবার্ষিকী পালন করছিলাম তখন তাঁর মাষ্টারমশাইয়েরও ২৪৫ তম জন্মবার্ষিকী নিঃশব্দে অতিবাহিত হয়ে গেল।
বিদ্যাসাগর-ই তো আমাদের কাছে প্রায় বলা যায় 'জাতীয় শিক্ষক', তাঁর আবার মাষ্টারমশাই! হ্যাঁ, যাঁর কথা আলোচনা করব তিনিও ছিলেন একজন সংস্কৃত পণ্ডিত, বাংলা ভাষার অন্যতম সংস্কারক, একজন শাব্দিক ও সাহিত্যিক। তাঁর নাম জয়গোপাল তর্কালঙ্কার।
পলাশী যুদ্ধের আঠারো বছর পরের কথা, গোটা দেশে ইংরেজ শাসন তখন বেশ কায়েম করেই বসেছে। সেই ক্ষণে ১৭৭৫ সালের ৭ই অক্টোবর জয়গোপাল তর্কালঙ্কার বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বজ্রাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কেবলরাম তর্কপঞ্চানন ছিলেন একজন সংস্কৃত পণ্ডিত। ছেলেবেলায় জয়গোপাল তাঁর পিতার থেকেই শিক্ষালাভ করেন। এভাবেই হয়তো সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার পাণ্ডিত্য পিতার থেকে পুত্র লাভ করে। আর সেই পাণ্ডিত্য প্রবেশ করে পুত্রের যোগ্য নক্ষত্রস্বরূপ ছাত্রদের মধ্যে, যাঁদের থেকে গোটা সমাজে। যাইহোক, পিতার কাছে শিক্ষাগ্রহণের পর জয়গোপাল চলে যান বারানসী বা বেনারসে (বাঙালিদের কাছে যা কাশী নামে পরিচিত)। সেখানে ছিলেন প্রাচ্যতত্ত্ববিদ হেনরি থমাস কোলব্রুক (১৭৬৫-১৮৩৭)। সেই সাহেবকে বাংলা ও সংস্কৃত শেখানোর জন্য পণ্ডিতরূপে নিযুক্ত হয়েছিলেন জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। বলাবাহুল্য, এই ইংরেজ হেনরি থমাস কোলব্রুক সাহেবও পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন একজন সংস্কৃতের পণ্ডিত।
১৮০৫ সাল থেকে ১৮২৩ সাল অবধি জয়গোপাল তর্কালঙ্কার শ্রীরামপুর মিশনে মিশনারি, গদ্য-বাংলায় পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তক, ব্রিটিশ খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক ও ধর্মযাজক উইলিয়াম কেরি (১৭৬১-১৮৩৪)-এর অধীনে কাজ করেছিলেন। সেইসময় বিখ্যাত ইংরেজ সাংবাদিক ও ঐতিহাসিক জন ক্লার্ক মার্শম্যান (১৭৯৪-১৮৭৭)-এর সম্পাদনায় প্রথম বাংলা সংবাদপত্র 'সমাচার দর্পণ'-এর প্রকাশনায় সহায়তা করেন। শুধু সহায়তাই নয় বা মার্শম্যান সাহেবের সহযোগী হিসেবে কাজ করাই নয়, ১৮১৮ থেকে ১৮২৩ সাল অবধি জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ছিলেন ওই সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান কর্মীদের মধ্যে অন্যতম। খুব যোগ্য ব্যক্তিরাই সাহেবদের থেকে এমন উচ্চ মর্যাদা পেতেন। সমাচার দর্পণ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে ফেলেছিলেন আর তা হল প্রচুর সংস্কৃত কঠিন বাংলাকে ভেঙে সহজ করে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছিলেন। আর এই কারণে তিনি একজন 'শাব্দিক' হিসেবে পরিচিত হন। আসলে এই কাজ করার পেছনে তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল যে বাংলা ভাষাকে পারসিক ও আরবীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করে ভাষার বিকাশ সাধন ঘটানো।এক্ষেত্রে তাঁকে বাংলা ভাষার সংস্কারকও বলা যায়।সমাচার দর্পণ পত্রিকায় কাজ করার মাঝেই ১৮১৯ সালে তিনি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর রচিত 'চণ্ডী'র সম্পাদনা করেছিলেন।
১৮২৪ সালে দেশের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। আর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই জয়গোপাল তর্কালঙ্কার সেখানে কাব্যের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। তিনি আমৃত্যু সংস্কৃত কলেজে কাজ করেছিলেন। এই কলেজে অধ্যাপক থাকাকালীন তিনি ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন একঝাঁক দিকপালদের। যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ– তারাশঙ্কর তর্করত্ন (মৃত্যুঃ ১৮৫৮), মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-১৮৫৮) এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) ইত্যাদি।
১৮৩০ সাল থেকে ১৮৩৪ সাল পর্যন্ত কাশীদাসী মহাভারত এবং ১৮৩৬ সালে কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর তিনি সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন। জানা গেছে যে, এই সংশোধনের কাজ করতে গিয়ে তিনি ওই কাব্যগুলিতে যথেচ্ছ পরিবর্তন করেছিলেন। এর ফলে সাহিত্যজগতে ও পাঠকসমাজে তিনি সুনাম ও দুর্নাম দুটোই কুড়িয়েছিলেন। তাঁর সংশোধিত রামায়ণ ও মহাভারত লোকের ভালো বা খারাপ যাই লাগুক না কেন এ কথা মানতে হবে যে বাজারে যে বাংলা ভাষায় রামায়ণ ও মহাভারত প্রচলিত আছে তা জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের কৃত সংশোধন ও সম্পাদনার ওপর নির্ভর করে প্রকাশিত হয়েছে। শুধু কাশীদাসী মহাভারত নয়, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে মহাভারত প্রকাশের ব্যাপারেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে।
জয়গোপাল তর্কালঙ্কার রাজা রাধাকান্ত দেব (১৭৮৪-১৮৬৭) প্রতিষ্ঠিত ধর্মসভার একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। তা সেই ধর্মসভার বিশিষ্ট সদস্য হিসেবে সভা কর্তৃক পরিচালিত পরীক্ষা ইত্যাদি নির্বাহ করতেন। সেই ধর্মসভার একজন সদস্য হিসেবে 'পারসিক অভিধান' নামে ফারসি ভাষায় একটি অভিধান সংকলন করেছিলেন। এছাড়াও, বাংলা সাহিত্যে তাঁর অনেক অবদান আছে। বিল্বমঙ্গল রচিত হরিভক্তিমূলক সংস্কৃত কবিতা বা কৃষ্ণবিষয়ক শ্লোকের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন জয়গোপাল ১৮১৭ সালে। বাংলার ছয়টি ঋতু বা ষড়ঋতু সম্পর্কে বর্ণনামূলক কবিতা রচনা করে গেছেন। এছাড়াও, ছোট ছোট নানান কবিতা রচনা করে গেছেন। এসবের জন্য তিনি 'সুকবি' হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। উল্লিখিত গ্রন্থগুলি ছাড়াও তাঁর রচিত আরও কিছু গ্রন্থের নাম হলঃ– 'শিক্ষাসার (১৮১৮, দ্বিতীয় সংস্করণ)', 'পত্রের ধারা (১৮২১)', 'বঙ্গাভিধান (১৮৩৮)' ইত্যাদি।
১৮৪৬ সালের ১৩ ই এপ্রিল সত্তরোর্ধ্ব বয়সে কলকাতায় পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্রঃ– বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (প্রথম খণ্ড)।
প্রতিবেদন- ইন্দ্রনীল মজুমদার
Post a Comment