মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের মেসবাড়ির একটি ঘরেই আজীবন কাটিয়েছেন শিবরাম চক্রবর্তী
মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের মেসবাড়ির একটি ঘরেই আজীবন কাটিয়েছেন, বলতেন 'মুক্তারামের তক্তারামে শুক্তোরাম খেয়ে' আরামে আছেন৷ বলতেন লেখক হয়েছেন পেটের দায়ে, 'গায়ের জোর নেই বলে রিকশা টানতে পারি না তার বদলে কলম টানি। কলমের ওপর টান আমার এইটুকুই'৷
দিলখোলা সদাহাস্যময় শিবরামকে শহর কলকাতার পথে-ঘাটে প্রায়ই দেখা যেত শৌখিন ঝলমলে পাঞ্জাবী পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ভক্তদের সঙ্গে দেখা হলে চকোলেট খাওয়াতেন হাসিমুখে৷ বাড়ির খাতাতেও হিসেব লিখতেন না, হিসেব লিখতেন দেওয়ালে। লম্বা সময় কম-বেশি ৬০ বছর লিখেছেন, হাস্যরসাত্মক গল্প ও রচনাকে সাহিত্য রচনার প্রধান মাধ্যম করেছিলেন৷ স্কুলে থাকতেই স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, প্রথাগত শিক্ষা বেশিদূর না এগিয়ে গেলেও পাণ্ডিত্য ছিল প্রখর, পড়াশোনা করতেন নানা বিষয়ে৷
শিশু সাহিত্যিক হিসেবে সমাধিক প্রসিদ্ধ হলেও অম্লমধুর টিকাটিপ্পণী এবং গুরুগম্ভীর রচনা পড়লে ঘুরে ফিরে আমাদের বারবার শিবরাম চক্রবর্তীর কথা মনে আসবেই৷ কথার পিঠে কথা চাপিয়ে সরস পান (Pun) রচনার ধারা তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তন করেছেন আর সেটাই যে শিবরাম স্টাইল নামে চেনেন তামাম সাহিত্য প্রেমী মানুষ৷
শিবরাম চক্রবর্তীর নামে নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করে লিখেছেন,এই নজির সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে বিরল৷ তাঁর কথা আলোচনা হলে শিবরাম চক্রবর্তীর মনে আসে স্মরনীয় সৃষ্টি কৌতুক চরিত্র হর্ষবর্ধন, গোবর্ধন দুই ভাই ও বিনির কথা৷
হাসির ঘটনা হাসির কথা তাঁর লেখনী পাঠককে সর্বদা সমৃদ্ধ করেছে, হাসির রাজা শিবরাম নামেই তাঁর নাম বিজ্ঞাপিত হত৷ জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতার মাতুলালয়ে, পিতা শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী একটু আধ্যাত্মিক মনোভাবের মানুষ ছিলেন, গৃহের বন্ধনে বেশিদিন থাকতেন না, মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশ হয়ে বেরিয়ে পড়তেন, পিতার এই ভবঘুরে ঘরপালানো স্বভাব শিবরামের মধ্যেও বোধহয় জাগ্রত হত!
তিনি কিশোর বয়স কাটিয়েছেন পাহাড়পুর পরে চাঁচোল, সেই বয়সে নিঃসম্বল অবস্থায় বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন, লাভ করেছিলেন জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, সেই অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তিনি রচনা করেছিলেন বাড়ি থেকে পালিয়ে, কাহিনীটি পরে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল৷ স্বদেশী কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেছেন তাঁর ভাষন শুনে এক কাপড়ে ট্রেনে উঠে কলকাতা এসেছিলেন, চিত্তরঞ্জনের দেওয়া ১০ টাকায় বই-খাতা না কিনে সিনেমা দেখে খেয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, অর্থের অভাব নেতাজির আত্মশক্তি পত্রিকায় কাজ পেয়েও শিবরাম সুলভ ভঙ্গিমা, বাঁধা-ধরা আফিসে অ্যালার্জি, অতএব যা হওয়ার সেটা হয়েছিল৷
'বিজলী', 'ফরোয়ার্ড', পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সাংবাদিকতা করতেন৷ ৫০০ টাকায় কিনেছিলেন 'যুগান্তর' পত্রিকা তবে রাজরোষে হাজতবাস করেছেন৷ সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রবেশ অবশ্য কবি হিসেবে, তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'মানুষ'৷ পরে আনন্দবাজার,বসুমতী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, লিখেছেন দেশ পত্রিকায়৷ ছোট-বড়দের জন্য সব মিলিয়ে দেড়শতাধিক বই শিবরাম লিখেছেন৷ 'ষোড়শী' নামে শরৎচন্দ্রের দেনাপাওনা উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছেন, তাঁর নিজের রচিত বিখ্যাত নাটক 'যখন তারা কথা বলবে'৷ রাজনীতি বাদ যায়নি লেখনীর ধারায়, লিখেছেন 'মস্কো বনাম পন্ডিচেরী'৷ আর 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা' নিজের আত্মজীবনীমূলক বই হলেও এই গ্রন্থে আমরা খুঁজে পাই সমসাময়িক সময়ের বহু চরিত্র ঘটনা, অনবদ্য সরস ভঙ্গীতে সেসব তিনি বর্ণনা করেছেন, সাধে কি আর পাঠক খুঁজে বেড়ায় শিবরাম চক্রবর্তী মহাশয়কে৷ একদিন সবাই কে থামতে হয়, থেমেছিল শিবরামের জীবন মুক্তারামের তক্তারাম ছেড়ে আকাশের তারা হয়ে চলে গিয়েছেন নাম না জানা দেশে, সেখানে যাওয়ার ৫ মিনিট আগে 'ফার্স্টক্লাস' আছি বলে চলে গিয়েছিলেন শিবরাম কিন্তু তিনি আছেন বাংলা সাহিত্যের অনুরাগীদের হৃদয়ে, আবেগে, মননে৷
তথ্যঋণ- নির্বাচিত জীবনী সমগ্র, নচিকেতা চক্রবর্তী
প্রতিবেদন- অরুণাভ সেন
Post a Comment