কৃষ্ণা নবমী তিথিতে দুর্গার বোধন হয় কোতোয়ালির সেন বাড়ির পুজোতে
আলোর ঝলকানি, লাখ টাকার থিম ও দামী মণ্ডপ, এমন পুজো দেখতে আমরা সবচেয়ে বেশি অভ্যস্ত। তবে বনেদি বাড়ির পুজোতেও আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। বনেদি বাড়ির পুজোগুলির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে প্রাচীন ইতিহাস। সাধারণত গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের রাজা ও জমিদাররা সূচনা করেছিলেন এই পুজোগুলি৷ শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও প্রথা মেনে আজও বনেদি বাড়ি কিংবা রাজবাড়ীতে দুর্গাপুজো হচ্ছে। ঠিক এমনই এক ঐতিহ্যবাহী পুজো হলো মালদা জেলার কোতোয়ালির সেন বাড়ির দুর্গাপুজো৷
মালদার বনেদি বাড়ির পুজোর মধ্যে সেন বাড়ির পুজো অন্যতম৷ প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন এই পুজো৷ প্রজন্মের পর প্রজন্মের ধারা দেখেছে সেন বাড়ির পুজো৷ পুরাতন মালদার বাচ্চামারি এলাকায় এই পুজোর সূচনা করেছিলেন মহেশ চন্দ্র সেন৷ বৈষ্ণব মতে এ বাড়িতে পুজো হয়। কথিত আছে, স্বপ্নাদেশেই নাকি পুজোর সূচনা হয় সেন বাড়িতে।
জন্মাষ্টমীর দিন থেকে শুরু হয় পুজোর আয়োজন৷ নিয়ম অনুযায়ী পঞ্চমীর দিন প্রতিমাকে বেদিতে তোলা হয়৷ ষষ্ঠীতে কল্পারম্ভ। সপ্তমীর দিন ঠাকুরের কলা বৌকে ঘাঘরা পরিয়ে পালকিতে করে মহানন্দা নদী থেকে স্নান করিয়ে আনা হয়। পুজোর বোধন শুরু হয় কৃষ্ণা নবমী তিথি থেকে। পুজোর চারদিন অন্নভোগ হয় না। শুকনো ভোগ দেওয়া হয় প্রতিমাকে। প্রচলন রয়েছে কুমারি পুজোরও।
সেনদের তিনটি পরিবার মিলে হতো এই পুজো৷ তাই এলাকাবাসীর কাছে এটি সেন বাড়ির পুজো নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে সেই বংশের আর কেউ জীবিত নেই। তাই এই পুজো চালিয়ে আসছেন সেখানকার দাশগুপ্ত পরিবার৷ দাশগুপ্তদের পাঁচটি পরিবার মিলে করে এই পুজো। দাশগুপ্ত পরিবারের প্রবীণ সদস্য প্রলয়প্রতিম দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে এই পুজো পরিচালিত হয়। পুজোর পূজারী, মৃৎশিল্পী, ঢাকিরা সকলেই বংশপরম্পরায় এই পুজোর সাথে যুক্ত।
দেবীর স্বপ্নাদেশে জমিদার মহেশচন্দ্র সেন প্রথমে ঘটে, তারপর পটে এবং শেষে মূর্তিপুজোর প্রচলন করেন। স্বপ্নাদেশে দেবী বলেন, পুজোর কিছু সামগ্রী তিনি নিজের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। সেসব নদীর ঘাটে রয়েছে। ঐ সামগ্রীগুলি যেন ঘাট থেকে তুলে আনা হয়৷ স্বপ্নে দেবীর নির্দেশ পেয়ে ঘুম থেকে উঠে ভোর হতেই মহেশ চন্দ্র সেন লোকজন নিয়ে তড়িঘড়ি ছুটে যান নদীর ঘাটে৷ তিনি দেখেন, সত্যি সত্যিই পুজোর বেশ কিছু সামগ্রী ও খড়্গ পড়ে রয়েছে।
দেবীর স্বপ্নাদেশে তিনি মহানন্দার ঘাটে পুজোর যেসব উপকরণ পেয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল দুটি পুষ্পপত্র, একটি গাড়ু, একটি পানের বাটা, পাঁচটি খড়্গ সহ আরও কয়েকটি জিনিস। সেসব এখনও আছে। পুজোর শুরুর দিন থেকে প্রতি বছর পুজোয় এই জিনিসগুলি এখনও ব্যবহৃত হয়। দেবীর আদেশ অনুসারে এখনও এখানে ডাকের সাজে প্রতিমা তৈরি করা হয়।
এখানকার পুজোর কয়েকটা দিনের জন্য দাশগুপ্ত পরিবারের প্রত্যেকে অপেক্ষা করে থাকেন। পরিবারের সদস্যরা যে যেখানেই থাকু্ক না কেন, পুজোতে সকলে বাড়িতে আসেন৷ প্রত্যেকদিন জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। এই পুজোকে কেন্দ্র করে এলাকাবাসীদের মধ্যেও প্রবল উন্মাদনা থাকে।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment