শেষের দিনগুলিতে রবি ঠাকুরের গানে, কবিতায় বেঁচে ছিলেন মাইকেল জ্যাকসন
জীবনের শেষ দিনগুলিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও গান নিয়ে রীতিমতো চর্চা করছিলেন মাইকেল জ্যাকসন। প্রয়াণের পূর্বে তিনি পড়ছিলেন গীতাঞ্জলী -এর কবিতাগুলি। একই সঙ্গে তিনি নিয়মিত ভাবে শুনছিলেন রবি ঠাকুরের গান। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর গভীর ভাবে রবীন্দ্র চর্চায় মন দিয়েছিলেন মাইকেল জ্যাকসন।
একালের অন্যতম জনপ্রিয় রকস্টার ক্যালকাটা ব্লুজের গায়ক ইমন সেনের সঙ্গে এক আড্ডায় উঠে এসেছিল জ্যাকসনের এই রবীন্দ্র চর্চার প্রসঙ্গ। ইমন বলছিলেন কি ভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে মিলনের কাজ আজও করে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে চর্চা করেছেন এমন বিদেশির তালিকা বেশ লম্বা। তবে তার মধ্যে মাইকেল জ্যাকসন অবশ্যই বিশেষ। এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই আলোচনা আরও তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, ঠিক এইসময় ভারতে NCERT এর পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে কবিগুরুর লেখা। এই দেশে এক শ্রেণীর মানুষের সৃষ্টি হয়েছে যাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের দর্শন 'অস্বস্তিকর' বলে মনে হচ্ছে। যা চেতনার নিম্নগামী প্রবণতার অভিযোগকে নিশ্চিত করে।
জ্যাকসনের জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব কিভাবে পড়েছিল সেটা তার মুখ থেকে জানা আজ অসম্ভব। কিন্তু তার শেষ লেখা গানটির দিকে যদি নজর ফেরাই তাহলে এক আধ্যাত্মিক দর্শনের কথা আমরা দেখতে পাবো। যে দর্শন রবি ঠাকুরের লেখায় বার বার উচ্চারিত হয়েছে। জ্যাকসন তার জীবনের শেষ যে গানটি রেকর্ডিং করেছিলেন সেখানে তিনি লিখেছিলেন "I am forever/ We are forever." এ যেন রবি ঠাকুরের ভাবনারই প্রকাশ।
দুবারের অস্কার জয়ী সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমানের সঙ্গে একটি সঙ্গীতের প্রকল্প করার পরিকল্পনা করেছিলেন জ্যাকসন। জানা যায় রহমানের মাধ্যমেই জ্যাকসনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টির পরিচয়।
রহমানকে মৃত্যুর কিছুদিন আগে জ্যাকসন তার জন্য একটি গান সুর করতে অনুরোধ করেছিলেন। সেই 'We are the World' নামের এই গানের মধ্যেও রবি ঠাকুরের দর্শন ভাবনার ছাপ খুঁজে পাওয়া যায় বলে মনে করেন এ আর রহমান। বিখ্যাত সঙ্গীত জার্নাল Contactmusic.com জানিয়েছে জীবনের শেষ দিনগুলিতে জ্যাকসনের সঙ্গী ছিল 'গীতাঞ্জলী'। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি পড়তেন। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল জ্যাকসনের। সেই শ্রদ্ধার জায়গা থেকেই তিনি আরও গভীর ভাবে বুঝতে চেয়েছিলেন এই সংস্কৃতি। রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতার থেকে ভালো আর কি ভাবেই বা এই উপমহাদেশের সংস্কৃতিকে অনুভব করা যায়। এই কারণেই 'গীতাঞ্জলী' জ্যাকসনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এ আর রহমান।
জানা যায়, রবি ঠাকুরের গানে রহমান আর জ্যাকসনের গলা মেলাবার কথা ছিল। যা আর হয়ে ওঠেনি। আরেকটি সূত্র থেকে জানা যায় জ্যাকসনের ভাই জারমাইন, প্রথমে ভারতের সঙ্গীত এবং সংস্কৃতি জানতে গেলে রবীন্দ্রনাথের গান শোনার পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁকে। জারমাইনের স্ত্রী হালিমা কিছুদিন ভারতে ছিলেন। তখন তিনি ভারতীয় সঙ্গীত এবং রবীন্দ্রনাথের গানের বিষয় জানতে পারেন।
১৯৯৬ সালে জ্যাকসন এসেছিলেন ভারতে। ফেরার আগে তিনি তাঁর ভক্তদের জন্য তাঁর নিজের বালিশের ঢাকনায় লিখে গিয়েছিলেন একটি বার্তা। এখানের মানুষের জীবন যাপন, দর্শন এবং ভারতীয় শিশুদের প্রতি তার ভালোবাসার কথা। তিনি লিখেছিলেন তিনি বারেবারে ফিরে আসতে চান এই মাটিতে। কিন্তু ফিরে আসা আর হয়নি। তাকে সময়ের কিছুটা আগেই বিদায় নিয়ে হয়েছিল এই পৃথিবী থেকে। তবে বিদায় মানেই সমাপ্তি নয়। জেগে থাকে স্মৃতি, জেগে থাকে চেতনা। সেই চেতনার সঙ্গে চেতনার যোগ সূত্র তৈরি হয় সুরের, দর্শনের আলোকিত পথ ধরে। রবীন্দ্র দর্শনে যেভাবে অবলীলায় মিশে যায় পার্থিব এবং অপার্থিব। তেমনই চেতনার যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল জ্যাকসনের সঙ্গে। যার সূত্র ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গান, কবিতা।
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥/ তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/ বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে॥/ তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,/ কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।/ নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ--/ সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে॥
প্রতিবেদন- অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়
Post a Comment