প্রচারের আড়ালে থাকা আলো অন্ধকারের চিত্রশিল্পী গনেশ পাইন আজও প্রাসঙ্গিক
পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকেন, যারা অত্যন্ত প্রতিভাবান হওয়া সত্বেও খ্যাতির পিছনে ছোটেন না। তারা সারা জীবন শিল্পকে ভালোবেসেই জীবন পার করে দেন। শিল্পের প্রতি অগাধ টান অনুভব করেন তারা। শিল্পের মধ্যে তারা নিজের জগতকে খুঁজে পান। এনারা অনেকটা সেই আদিমকালের সেই অচেনা গুহা চিত্রকরদের মতো, যারা পাথরের গায়ে সভ্যতাকে এঁকে রেখেও নিজেদের প্রকাশ করতে নারাজ। চিত্রশিল্পী গণেশ পাইনও সেরকমই একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন।
চিত্রশিল্পী গণেশ পাইন নিজের প্রতিভাকে রং-পেন্সিল ও তুলির আঁচলেই বেঁধে রেখেছিলেন। তিনি প্রতিনিয়ত শিল্পকলার নীল আকাশে খেয়া হয়েই ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি বিনা প্রচারে বিনা আড়ম্বরে জয় করেছেন বিশ্ব। তাঁর ভাবনা আর তুলি সর্বদা নিজস্ব এক ভাষা নিয়ে এগিয়ে গেছে গভীর থেকে গভীরে। জীবন ও শিল্পের অতল গভীরে তিনি ডুবে থাকতে চেয়েছেন সর্বদা।
বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমসাময়িক শিল্পীদের একজন তিনি, যিনি বাংলার লোককাহিনী এবং পৌরাণিক কাহিনীর থিমগুলি সম্পর্কে 'কাব্যিক অতিরিওবাদ', ফ্যান্টাসি এবং গাঢ় চিত্রশিল্পের নিজস্ব শৈলী গড়ে তোলেন৷
তাঁর জন্ম কলকাতায়। তিনি জীবনের মধ্যভাগ পেরিয়ে কিছু দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি ভ্রমণ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "আমার জীবনে ব্যাপ্তি নেই, বৈচিত্র্য নেই, ভ্রমণে আমার প্রবল অনীহা।" তিনি পশ্চিমি শিল্প ও ভারতীয় শিল্পের সংমিশ্রণে তিনি নিজস্ব শিল্প-মানস তৈরি করেছিলেন। তাঁর শৈল্পিক শিক্ষা লাভ হয় কলকাতার এক সরকারি আর্ট কলেজে৷ মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই, ১৯৫৭ সালে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ সিপাহী বিদ্রোহের শতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত প্রদর্শনীতে ঠাঁই পায় তাঁর ছবি৷ গণেশ পাইনের শিল্প-অভিসার এক বাঙালির স্বকীয়তার সন্ধানে, আত্মপরিচয়ের সন্ধানে যাত্রা। সেই যাত্রা বজায় ছিল তাঁর জীবনের অন্তিম পর্ব পর্যন্ত।
গণেশ পাইনের ছবি মূলত আত্মজৈবনিক, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে শিল্পী পৌঁছে যান এক অজানা বৌদ্ধিক জগতে... নান্দনিকতার অন্য মাত্রায়। তিনি ছবিতে সরাসরি সমকালকে হাজির করেন নি, সহজে ধরা যায় না প্রত্যক্ষ সময়কে। তাঁর ছবিতে ও ভাস্কর্যের চরিত্রের চোখে মর্মর মূর্তির শূন্যতা-স্থবিরতা-নৈর্ব্যাক্তিকতা,শরীরে ঔপনিবেশিক ও আধুনিক ভোগবাদ, আবার তারই সামনে হাজির হয় কালের করাল হাতছানি। কাল সেখানে এসে দাঁড়ান নানান রূপে।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, "রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে একটা দেওয়ালের মতো, যে দেওয়াল ধরে সাহিত্যের পথে তিনি শিশুর মতো হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটতে শিখেছিলেন; তেমনি গণেশও রেমব্রান্ট-যামিনী-গগন-অবনের মতো পূর্বসূরীদের হাত ধরে হাঁটতে শিখে তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজস্ব সাররিয়াল আলো-আঁধারির এক পথ। যে পথে তিনি এমন একজন স্বতন্ত্র সম্রাট, কালে কালে যাঁর সভায় হাজির হয়েছেন অসংখ্য অনুগামী। একজন প্রকৃত শিল্পীর কাছে এর থেকে বড় প্রাপ্তি কি-ই বা হতে পারে?"
১৯৭০-এর দশকের রাগ ও হতাশার ফলে শিল্পী হিসেবে তিনি ফুটিয়ে তোলেন 'বিফর দ্য চেরিওট' এবং 'দ্য অ্যাসাসিন' এর মতো কাজগুলিতে। ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে, তিনি বিশ্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলেছিলেন, তার বন্ধুবান্ধব শিল্পকলা বাজারে যে ঈর্ষা ও ক্ষুদ্রতা সৃষ্টি করেছিল সেখান থেকে তিনি দূরে চলে গিয়েছিলেন। তার জল রং করা ও স্কেচ আঁকা, সেগুলি ওয়াল্ট ডিজনি ও অবন ঠাকুরের শিল্পের দ্বারা প্রভাবিত। তাঁর অন্যান্য প্রভাব ফ্রানস হালস, রেমব্র্যান্ডট ও পল ক্লী।
সত্তরের দশকে তাঁর ছবির মধ্যে যে অন্ধকারাচ্ছন্ন আবহ ছিল, সেটা আশির দশকে আলোর দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। 'দি টিথ', 'ঘাতক', 'হর্স অ্যান্ড হেড', 'হারবার', 'ব্ল্যাক মুন', 'মারসেট' ইত্যাদি অনেক বিখ্যাত ছবি আত্মপ্রকাশ পায়, যা আজও অসাধারণ হয়ে আছে। এ-সময়টাতে তিনি নিজেকে প্রসারিত করেন। বলা চলে, এটাই তাঁর মাহেন্দ্রক্ষণ। তাঁর ছবির বিষয়বস্তু কী ছিল না- লতাপাতা, গাছফুল, পাখি, কঙ্কাল, পুরনো দেয়াল, হরিণ, মানুষ, ইতিহাস, চাঁদ সবই৷
প্যারিস, লন্ডন, ওয়াশিংটন ও জার্মানিসহ বিশ্বব্যাপী তাঁর চিত্রশিল্পের প্রদর্শনী হয়েছে। যদিও তিনি নিজে খুব একটা তেমন প্রদর্শনী পছন্দ করতেন না৷ তাঁকে আলো অন্ধকারের শিল্পী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। চিত্রশিল্পের দুনিয়ায় তিনি ছিলেন একজন অভিভাবক। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শিল্প দিয়ে অসাধারণ পৃথিবী গড়তেই ব্যস্ত থেকে যান তিনি৷ প্রচারের আলোকে তাঁকে বিশেষ দেখা যায় নি৷ কিন্তু তিনি আজও আমাদের কাছে চির প্রাসঙ্গিক।
তথ্যসূত্র- কালি ও কলম, পার্থসারথি পাণ্ডার প্রতিবেদন (চ্যানেল এইচ), দৃশ্যতা আর্ট ম্যাগাজিন, উইকিপিডিয়া।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment