দুটো পা অসাড় তবুও দীপাবলিতে লক্ষ লক্ষ প্রদীপ বানান শিলিগুড়ির সাধন পাল
বাংলার শিল্পীদের শিল্পের খিদে সর্বদা অন্যরকম হয়। শিলিগুড়ির চয়নপাড়া পালপাড়ার বাসিন্দা সাধন পালের কথা বলতে গেলেই এমন ভাবনা ভেসে আসতে পারে। সাধন পাল পেশায় একজন মৃৎশিল্পী। তাঁর পায়ে চলার শক্তিটুকুও নেই তবুও শিল্পের নেশায় সারাদিন ডুবে থাকেন তিনি। নিজের হাতে যত্ন সহকারে প্রদীপ বানিয়ে ফেলেন তিনি।
বয়স তখন তাঁর আট বছর, টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর দুটো পা অসাড় হয়ে যায়। ছেলেবেলা থেকেই তিনি পঙ্গু হয়ে পড়েন। জীবনযুদ্ধে তখন হেরে যাওয়ার উপক্রম তাঁর। তবে মানুষ এতো সহজেই হেরে যায় না। জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য মানুষ দাঁতে দাঁত কামড়েও লেগে থাকে। তিনিও নিঃশব্দে থেমে যাননি। বাবা ও ঠাকুরদার কাছে মাটি দিয়ে প্রদীপ তৈরির কাজ শিখতে শুরু করেন তিনি। অল্পদিনের মধ্যেই তা তিনি শিখে ফেলেন। তারপর থেকে কাদামাটির সঙ্গেই সংসার গড়তে আরম্ভ করেন তিনি।
তাঁর হাতে তৈরি মাটির প্রদীপ নিয়ে বাংলার সীমানা পেরিয়ে দিল্লি বা মুম্বাইতে অনেক মানুষ দীপাবলিতে আলোর উৎসবে মেতে ওঠেন। অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাওয়ার উৎসবে তাঁর হাতে তৈরি প্রদীপ অনেকের মনে উদ্দীপনা তৈরি করে। অথচ যিনি এই প্রদীপ বানাচ্ছেন, তিনি অন্ধকারে একাকী মলিন।
শিল্পী সাধন পালের বর্তমান বয়স ৬৮ বছর। এতো বছর বয়স হলেও তিনি এখনও মাটির প্রদীপ গড়তে সিদ্ধহস্ত। প্রত্যহ গড়ে তিনি দেড় থেকে দু'হাজার প্রদীপ অনায়াসেই বানিয়ে ফেলেন। প্রত্যেক বছর দীপাবলির আগে তিনি সমস্ত প্রকার জড়তা কিংবা প্রতিবন্ধকতাকে সরিয়ে এক থেকে দেড় লক্ষ প্রদীপ তৈরি করেন। এবারও তাতে খামতি নেই। বরঞ্চ এবার প্রদীপের চাহিদা আরও বেশি।
এবার দুর্গাপুজোর আগে বাংলার উত্তরের জেলাগুলিতে দুর্যোগের কারণে বহু কারিগর একেবারে কম প্রদীপ তৈরি করেছেন। যার ফলে বাজারে প্রদীপের চাহিদা তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ ভারত থেকেও অতিরিক্ত মাটির প্রদীপের চাহিদা তৈরি হয়েছে। গতবছর যেখানে এক হাজার মাটির প্রদীপের দাম ছিল চারশো থেকে সাড়ে চারশো টাকা, এবার তা হয়েছে ছশো থেকে সাতশো টাকা। কেবল মুম্বাই বা দিল্লিতে নয়, স্থানীয় এলাকায় ট্রাই সাইকেলে চেপে নিজের হাতে তৈরি প্রদীপ বিক্রি করেন এই মৃৎশিল্পী। তবে সাধনবাবুর আসল সমস্যা হলো অর্থনৈতিক সংকট। এই কাজে তাঁর তেমন মোটা টাকা আসে না বললেই চলে। তবুও প্রদীপ বানানোর নেশার জন্য দিনের পর দিন এ কাজ তিনি করে চলেছেন। করোনা আসার পূর্বে দীপাবলির সময় চিনের আলো সর্বত্র বাজার দখল করে নিয়েছিল। যার ফলে প্রদীপের ব্যবসাতে প্রচণ্ড ক্ষতি লক্ষ্য করা যায়। করোনা আসার পর চিনা আলোর বাজার বেশ ধাক্কা খেয়েছে। সেদিক থেকে বিচার করলে মাটির প্রদীপের বাজারের চাহিদা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। মৃৎশিল্পী সাধন পাল তাঁর লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মাটির প্রদীপের সাথে সাথে মাটির ধুপতি, কলস, ঘটও তৈরি করেছেন।
প্রতিবেদন- নিজস্ব সংবাদদাতা
Post a Comment