Header Ads

নেতাজীর উৎসাহে বাংলায় শুরু হয়েছিল 'বীরাষ্টমী'


নেতাজীর উৎসাহে বাংলায় শুরু হয়েছিল 'বীরাষ্টমী', অস্ত্রের অঞ্জলি, সময়টা ১৯১৯-১৯২০ সাল। বাংলা জুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। স্বদেশী ভাব ধারায় উদ্বুদ্ধ এক তরুণ প্রজন্ম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাংলা জুড়ে। ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে কলকাতা, মেদিনীপুর, খুলনা, রাজশাহী অখণ্ড বাংলার প্রতিটি কোনে সেই সময় তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বিপ্লবী দল। কিন্তু তারা বিচ্ছিন্ন। একে অপরের সঙ্গে সংযোগহীন। এমন কয়েকটি বিপ্লবী দল ঠিক করলো এক ছাতার তলায় আনতে হবে সবকটি দলকে। কিন্তু কি হবে এর উপায়! ভাবতে ভাবতে শরতের আকাশের পেঁজা তুলোর মেঘের সঙ্গে বাংলায় ভেসে এলো পূজা। পূজার এই সময়টাকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা নিলেন বিপ্লবীরা। তারা ঠিক করলেন একদিকে উৎসব হবে আর তার আবহে একত্রে আনা হবে বিপ্লবীদের।বিভিন্ন জায়গায় এর মধ্যেই তৈরি হতে শুরু করেছে ব্যায়ামাগার, আখড়া, লাঠি খেলা, ছুরি খেলার ক্লাব।


১৯২৬ সালে বিপ্লবীদের আখড়া বলে পরিচিত সিমলা ব্যায়াম সমিতির মাঠে শুরু হলো সার্বজনীন দুর্গা পূজা। ততদিনে সিমলা ব্যায়াম সমিতি পুলিশের নজরে। সার্বজনীন দুর্গাপূজা শুরু হতেই সেখানে সাধারণ মানুষের আনাগোনা গেলো বেড়ে। সুবিধা হলো বিপ্লবীদের। 

সেই সময় সিমলা ব্যায়াম সমিতি ছিল লাঠিখেলা, তলোয়ার চালনা, কুস্তি প্রভৃতি শেখার প্রধান আখড়া। সারা বছর ধরে এই সমস্ত কিছুর চর্চা চলতো সেখানে। দুর্গা পূজার অষ্টমীর দিনটিকে বেছে নেওয়া হতো এই সব কিছুর পরীক্ষার দিন হিসেবে। এই দিনটিকে তারা পালন করতেন 'বীরাষ্টমী দিবস' হিসেবে। উদ্দেশ্য একটাই, বাঙালিকে তার শক্তি সম্বন্ধে সচেতন করা, তাকে জাগিয়ে তোলা। ততদিনে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রবল হাওয়া বইতে শুরু করেছিল বাংলার বুকে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

বীরাষ্টমীর আলাদা একটি পৌরাণিক তাৎপর্য আছে। বীর সন্তান লাভ করার জন্য নারী এবং পুরুষের বীরাষ্টমী ব্রত পালনের কথা সেখানে বলা আছে। তবে বাংলায় 'বীরাষ্টমী দিবস' পালিত হতো বাংলা মায়ের সন্তানদের জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে সরলা দেবী চৌধুরানী বাংলার যুবকদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উপযুক্ত করার উদ্দেশ্যে তাদের অস্ত্র শিক্ষা প্রদানের জন্য বীরাষ্টমী ব্রত পালন শুরু করলেন। সেই সময় তাঁর উদ্যোগেই সেই সময়ে  প্রতাপাদিত্য উৎসবও পালিত হতো।

১৯২৭ সালে বার্মা জেল থেকে মুক্তি পেলেন নেতাজি। ১৯২৮ সালের কলকাতার বিভিন্ন দুর্গা পূজায় যুক্ত হলেন তিনি। প্রথম থেকেই তিনি লাঠি খেলা, কুস্তি প্রভৃতিকে উৎসাহ দিতেন। তিনি যুক্ত হওয়ায় পূজাগুলির উৎসাহ আরও বেড়ে গেলো। 

১৯৩০ সালে কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর, বেশ কিছু পূজা কমিটিতে নেতাজিকে সভাপতি করা হলো। নেতাজির উদ্যোগে ও স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে সিমলা ব্যায়াম সমিতির পূজাতে প্রতিমাকে তখন দেশীয় খাদি বস্ত্র পরানো শুরু হলো। একই সঙ্গে আশেপাশের ক্লাবগুলিতে চালু হলো বীরাষ্টমী।

অনুশীলন সমিতির লাঠি খেলা, শরীর চর্চার প্রদর্শনী হতো বাগবাজার সার্বজনীন পূজা মণ্ডপে। সরলা দেবী নিজ দায়িত্বে বাগবাজারে বীরাষ্টমী উৎসবের সূচনা করেছিলেন। 

শুধু বীরাষ্টমী নয় বিপ্লবীরা বুঝতে পরেছিলেন দেশীয় শিল্পকেও উৎসাহ দান করতে হবে। বিশেষ করে সেই শিল্পকে যা বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। পূজা গুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মতো ব্যক্তিত্ব। এই পূজা গুলিকে কেন্দ্র করেই দেশীয় শিল্প নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা শুরু হয়। এই প্রদর্শনী ধীরে ধীরে বাংলার শিল্প মেলায় পরিণত হয়।

যারা আজও বীরাষ্টমী উৎসবে অংশ গ্রহণ করেন তাদের মতে, অষ্টমীর দিনে লাঠি খেলা, ছুরি খেলা বর্তমানে ক্যারাটে সহ অন্যান্য শরীর চর্চার প্রদর্শন আসলে শক্তি রূপিণী দেবীকে বীর সন্তানদের অঞ্জলি। যার শুরুর সঙ্গে যুক্ত নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস সহ নানা বিপ্লবীর নাম। এই প্রথা আজও বজায় রেখে চলেছে সিমলা ব্যায়াম সমিতি, বাগবাজার সার্বজনীনের মতো ক্লাবগুলি। 

করোনা প্রভাব কিছুটা বাঁধা সৃষ্টি করলেও থামিয়ে রাখতে পারেনি। সময়ের দাবি, সমস্ত বাংলার সমস্ত উৎসব কমিটি নিজেদের মতো করে আবার চালু করুক শরীর চর্চার এই প্রদর্শনী। পাড়ার যুবক যুবতীরা এগিয়ে আসুক সুভাষ চন্দ্র বোসের দেখানো পথ ধরে। বঙ্গ  বীর-বীরাঙ্গনাদের তেজে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক প্রতিটি মণ্ডপ।

প্রতিবেদন- অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়


No comments