Header Ads

পার্কস্ট্রিটের নাম কেন হয় পার্কস্ট্রিট?


ঐতিহাসিক নগর কলকাতা। যে শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার ইতিহাস। যা লিখতে গেলে মনে হবে "শেষ হইয়াও হইল না শেষ।" কলকাতার পুরোপুরি ইতিহাস একজন মানুষের পক্ষে জানাও সম্ভব নয়। কলকাতা সম্পর্কে যে তথ্য বহুল প্রচলিত তা হলো কলকাতার ইতিহাস তিনশো বছরের পুরানো। এই তথ্য সম্পূর্ণ ভুল। কারণ বাংলার অনেক প্রাচীন গ্রন্থেও কলকাতার উল্লেখ আছে। মনসা মঙ্গল কাব্যে কলকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়াও সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার একসময় গোটা কলকাতা কিনে নিয়েছিল। এই পরিবারের ২১ তম পুরুষের জন্ম হয়েছিল ১৫৩৮ সালে৷ একমাত্র এই পরিবারের বর্তমান সদস্যরাই সঠিক ভাবে বলতে পারবেন কলকাতা ঠিক কত প্রাচীন। অতএব কলকাতার সম্পূর্ণ ইতিহাস কারও পক্ষে জানা প্রায় অসম্ভব।  


জেলার মানুষদের কাছে কলকাতা বললেই সবার প্রথমে অলিগলি রাস্তার কথা স্মরণে আসে৷ কলকাতার এক একটা রাস্তার এক একটা ইতিহাস আছে। কয়েক বছর আগে কলকাতায় একটা মজার ঘটনা ঘটে যায়। ২০০৪ সাল থেকে কলকাতার রাস্তাঘাটের নাম পাল্টে ফেলার হিড়িক পড়ে যায়। ঠিক হয় রাস্তা বা সরণীগুলি থেকে ব্রিটিশ আমলের ব্যক্তিদের নাম পরিবর্তন করে এ দেশের বিভিন্ন মহান ব্যক্তিদের নামে রাখা হবে। সেইমতো একটার পর একটা রাস্তার নাম বদল হতে শুরু করে। তবে ইতিহাস তো আর এভাবে বদলানো সম্ভব হয়না। যেমন মধ্য কলকাতার অতি পরিচিত স্থান পার্কস্ট্রিট। যার বর্তমান নাম মাদার টেরেসা সরণী। তবুও শহরের অত্যন্ত এ গুরুত্বপূর্ণ রাজপথটির নাম লোকমুখে সেই পার্কস্ট্রিটই থেকে গেছে।  

কলকাতা কর্পোরেশনের নথি বলছে, সরকারিভাবে রেকর্ডবুকে এ রাস্তার প্রথম নাম ওঠে ১৭৬০ সালে। নথি দেখলে বোঝা যায়, আজকের মাদার টেরেসা সরণী তথা অধুনা পার্কস্ট্রিট রাস্তাটির ক্ষেত্রে নাম বদল কোনও নতুন ঘটনা নয়। কলকাতা যত আকারে আয়তনে বেড়েছে, ততই বিবর্তন ঘটেছে পার্কস্ট্রিটের।  

একসময় এ পার্কস্ট্রিটের উপরেই ছিল বিখ্যাত সাহেবি নাট্যশালা সাঁসুচি থিয়েটার। পরে যেখানে হয়েছে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। আর আছে এশিয়াটিক সোসাইটি৷ ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের সূচনাও এখানে হয়েছিল।  

আজকের এই পার্কস্ট্রিটের নাম পার্কস্ট্রিট হওয়ার পিছনে রয়েছে ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্য। যে তথ্য জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৭৬০ সালের দিকে। পার্কস্ট্রিটে এখন মিডলটন রো-এ যেটা লোরেটো হাউস, আগে সেটা ছিল গভর্নর ভ্যানসিটার্টের পল্লীনিবাস। ঔপনিবেশিক ধাঁচের সেই বাড়ির লাগোয়া ছিল বিশাল বাগান৷ উইলিয়াম ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড নামের এক সাহেব এই বাগানের মালিক ছিলেন৷ যদিও এ বাড়ির বিলাসিতা মাত্র বছর চারেক ভোগ করতে পেরেছিলেন গভর্নর হেনরি। নবাব সিরাজউদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করেন তখন তিনি পরিবার ফেলেই স্যার হেনরি ভ্যানসিটার্ট বাড়ির জানালা পথে নৌকা করে পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন।  

তাঁর পরে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার ইলাইজা ইম্পে এই বাড়িতে ১৭৭৪ সন থেকে ১৭৮২ সন পর্যন্ত বাস করেন। এই বাড়ির চতুর্দিকে প্রকাণ্ড এক পার্ক ছিল। তাতে নাকি হরিণ থাকতো। লোকে বলতো 'ডিয়ার পার্ক'। বাগানের চার সীমানা আবৃত ছিল উঁচু পাঁচিলে। বাগানটি বিস্তৃত ছিল পূর্বে ক্যামাক স্ট্রিট থেকে পশ্চিমে রাসেল স্ট্রিট পর্যন্ত, আর দক্ষিণে বেরিইং গ্রাউন্ড রোড পর্যন্ত। এই রোডের ওপর একটি ফটক ছিল। সেই ফটকে ঢুকে দু পাশে দু'সারি ঘন গাছের মধ্য দিয়ে জর্জ সাহেবের বাড়িতে যাওয়া যেত। সেই দু'সারি গাছের বীথির জায়গাটাই এখন হয়েছে-- মিডলটন রো। আর ইম্পের পার্কের জন্যই বেরিইং গ্রাউন্ড রোডের নাম হয়েছে পার্কস্ট্রিট। 

বর্তমানে পার্কস্ট্রিট হলো কলকাতার সবচেয়ে আভিজাত্যপূর্ণ এক এলাকা। যার দু'ধারে গড়ে উঠেছে সেন্ট  জেভিয়ার্স কলেজ, ফ্রিমেসনস হল, এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের মতো প্রতিষ্ঠানসহ অজস্র অতি উচ্চবিত্ত পরিবারের বাসভবন। সময়ের স্রোতে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে পার্কস্ট্রিটের মানচিত্র। ভিন রাজ্যের বেণিয়া গোষ্ঠীদের চাপে বদলে যাচ্ছে পার্কস্ট্রিটের জনবিন্যাসও। যা বাঙালির কাছে অত্যন্ত বেদনার। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে

তথ্যসূত্র- কলিকাতা দর্পণ, রাধারমণ মিত্র

   


No comments