Header Ads

অদ্বিতীয় সত্যজিৎ, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তো তিনিও


প্রবাদপ্রতিম চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় মহাশয়ের 'পথের পাঁচালীর' ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়েছিল আমেরিকায়, হঠাৎ ঠিক হয়েছিল ছবি পাঠাতে হবে, সম্পাদনা করতে গিয়ে দশদিন দশরাত ঘুম হয়নি বলা যায়, মানুষ যে দশটা রাত একটানা জেগে থাকতে পারে তখন বুঝতে পেরেছিলেন তিনি৷ নিজেই দুঃখ করে বলেছেন অনেক সুক্ষ বিচারশক্তি বোধ শরীরের ওই অবস্থায় নষ্ট হয়ে যায়, ফলে এডিটিং-এ ক্রুটি থেকে গিয়েছে, তার জন্য তাঁর মনে দুঃখ ছিল৷ নিজের মুখে তিনি বলেছেন " 'পথের পাঁচালী'-কে নতুন করে এডিট করতে পারলে আমি খুব খুশি হতাম৷ নতুন করে কাঁচি চালাতে পারলে প্রথম দিকের কিছু দৃশ্য ছোট হতো৷ জিনিসটা আরও পরিপাটি ও ছিমছাম হতো, গতি বাড়তো৷ গোড়ার দিকের কিছু দৃশ্য বড্ড কাঁচা লাগে"৷ সত্যি বলতে কি বিজ্ঞাপনের অফিসে যখন আর্ট ডিরেক্টরের চাকরি করতেন, নিজে কোনওদিন ভাবেন নি চিত্র পরিচালক হবেন৷ তবে সিনেমা দেখতে ভালবাসতেন, সেই ভাললাগা পরে সিরিয়াস টার্ন নিয়েছিল৷ 


খুব ইন্টারেস্টিং তথ্য তিনি দিয়েছিলেন শংকর কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হুবহু সেটা বরং তুলে দেওয়া শ্রেয়- "অনেকে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, মূল উপন্যাসটা পড়বার আগেই আমি 'পথের পাঁচালী' ছবি তৈরির সিদ্ধান্ত নিই৷ ডি কে গুপ্তর প্রকাশন সংস্থার জন্য সংক্ষিপ্ত কিশোর সংস্করণ 'আম-আঁটির ভেঁপু-র' ইলাসট্রেশন করছিলাম, সেইসময় আইডিয়াটা মাথায় এসে গেল৷ সংক্ষিপ্তসারটাই আমাকে ভরসা দিল ছবিটা ম্যানেজেবেল ফর্মে আনা যায়, মূল উপন্যাসটা প্রথমে পড়লে হয়তো এই সাহস আমার হতো না।"

অফিসের কাজে বিলেতে গিয়েছিলেন, চাকরির ফাঁকে-ফাঁকে প্রচুর সিনেমা দেখতেন, অবশ্য তখন বিজ্ঞাপন এজেন্সির কাজ সম্পর্কে তখন তাঁর মনে একপ্রকার ক্লান্তি, কিছুটা হলেও বিতৃষ্ণা জন্ম নিয়েছিল, মনের কোনে ইচ্ছা জাগে স্বাধীন কাজ করবেন৷ ইউরোপীয় ছবি দেখেই কার্যত তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল অল্প খরচে মানবিক আবেদন সম্পন্ন ছবি আমরা কেন তৈরি করতে পারব না! ১৯৫০সালে দেশে ফেরার সময় জাহাজে চিত্রনাট্যের একটা খসড়া সত্যজিৎ রায় তৈরি করেছিলেন৷ কলকাতায় ফিরে অফিস-চিত্রনাট্যে তৈরির কাজ করছেন৷ প্রযোজকদের দরজায়-দরজায় ঘুরেছেন, অনেক কে চিত্রনাট্য শুনিয়েছেন, কিন্তু টাকা ঢালতে কেউ রাজি হননি৷ তারপর তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিজেদের যা সঙ্গতি আছে তাই দিয়ে 'পথের পাঁচালী' ছবির কাজ শুরু করবেন৷ ছবি করার ইচ্ছার কথা অফিসের ইংরেজ অফিসারকে বলতে ম্যানেজার সাহেব তাঁকে উৎসাহ দিয়েছিলেন, সঙ্গে বলেছিলেন উইক এন্ড আর ছুটি-ছাটায় যেন কাজ করেন, একমাসের সবেতন ছুটিও মঞ্জুর হল৷ ১৯৫৩ সালে অক্টোবর মাসে জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন এক কাশবনে শ্যুটিং শুরু হল৷ থিয়োরি অনেক ছিল মাথায় কিন্তু হাতে-নাতে কাজ করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন৷

চুনিবালা দেবীর সন্ধান সত্যজিৎ রায় মহাশয়কে দিয়েছিলেন রেবা দেবী৷ চুনিবালা দেবী একসময় তারাসুন্দরী নগেন্দ্রবালার সঙ্গে মঞ্চে অভিনয় করেছেন৷ অনেক কথায়, লেখায় চুনিবালা দেবীর প্রতি মানিকবাবুর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ঝরে পড়েছে, সর্বদা তিনি বলেছেন এঁর সন্ধান না পেলে তাঁর 'পথের পাঁচালী' হতো না৷

আড়াই বছর ধরে ছবির কাজ চলেছে, টাকার অভাবে দীর্ঘ সময় ছবির কাজ বন্ধ তখন কেউ মানিকবাবু কে বলেছিলেন ডাঃ বিধান রায় কে ধরলে হয় না? বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে যিনি সত্যজিৎ রায়ের যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে 'পথের পাঁচালী'র অকালমৃত্যু রক্ষা করেছিলেন তিনি শ্রীমতি বেলা সেন, উদার হৃদয়ের এই মানুষটি কোনওদিন আত্মপ্রচার চান নি৷ রাজ্য সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেও ছবির কাজ শেষ করতে একবছর সময় লেগেছিল কারণ একবারে সব টাকা পাওয়া যায়নি৷ এই ঘটনা প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনার কথা বলা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না, সরকারি অনুদান তখন আসেনি, অথচ এমন সে সময় ইউনিটের সবাইকে খাওয়াবার দু'শো টাকা সত্যজিৎ বাবুর কাছে নেই, বিজয়া রায় সন্তানসম্ভবা৷ অনিল চৌধুরীর উপর ইউনিটের ভার, তিনি নিরুপায় হয়ে বিজয়া রায় কে বললেন সব কথা৷ নিজের হাতের বালা খুলে দিলেন বিজয়া রায়, সেটা বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় হল৷ ঘরের বউ গয়না বন্ধক দিয়েছে জানলে সুপ্রভা দেবী রাগ করবেন, সেইজন্য ঘরোয়া সামাজিক অনুষ্ঠানে অন্য এক মহিলার সোনার বালা জমা দিয়ে বন্ধকীর দোকান থেকে বিজয়া রায়ের বালা জোড়া ধার করে আনা হয়েছিল যাতে সুপ্রভা দেবী আসল ব্যাপারটা বুঝতে না পারেন৷ এই প্রসঙ্গে আর একটি তথ্য বলা প্রয়োজন টাকার অভাব অথচ বৃষ্টির দৃশ্য দরকার, যখন টাকা হাতে এলো তখন শরৎকাল, রোজ গ্রামে গিয়ে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতে হতো বর্ষাকালের মতো বৃষ্টি কবে হবে, আশাপূরণ হলো অক্টোবরে প্রবল বৃষ্টি নামলো৷ 

'পথের পাঁচালী'র জন্য সেইসময় খরচ হয়েছিল দু-আড়াই লাখ টাকা, একসময় 'রাণা এন্ড সন্স' থেকে হুন্ডিতে নিতে হয়েছিল হাজার কুড়ি, চিত্র স্বত্বের জন্য বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার সম্ভবত পেয়েছিলেন দশ হাজার৷ প্রচার অধিকর্তা মাথুর সাহেবের কিছু ভুলে 'পথের পাঁচালী'র বিদেশী স্বত্বের একটা লভ্যাংশ তিনি পান নি, তারজন্য মানিকবাবুর ছিল না কোনও আক্ষেপ, বরং বলেছিলেন "কোনও দুঃখ নেই, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগটা আমি ওখান থেকেই পেয়েছি, সেটার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ৷ ছবিটা শেষ না হলে আমাকে বিজ্ঞাপন অফিসের দাসত্ব করতে হতো৷ আমি যে ফিল্ম মেকার হতে পেরেছি এর জন্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার দায়ী।"

এরপরের ইতিহাস সম্পর্কে আর নতুন করে কিছু বলার নেই, শুধু এটুকু বলা যায় শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের কথা যখন আলোচনা হয়, সেই তালিকায় সর্বকালে সত্যজিৎ রায় মহাশয়ের নাম থাকবেই৷ 

প্রতিবেদন- অরুণাভ সেন

গ্রন্থ ও চিত্রঋণ স্বীকার-  সত্যজিৎ রায় সাক্ষাৎকার সমগ্র, সম্পাদক সন্দীপ রায়


No comments