চিরকালের রোম্যান্টিক জুটি উত্তম-সুচিত্রা উভয়ের গানের প্রতি ছিল অমোঘ টান
বাংলা চলচ্চিত্রের চিরকালের রোম্যান্টিক জুটি উত্তমকুমার-সুচিত্রা উভয়ের গানের প্রতি ছিল অমোঘ টান৷ উত্তমকুমার নিজের ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন, আবার পুজোর সময় বের হয়েছিল মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের সুরেলা কণ্ঠে গাওয়া আধুনিক বাংলা গানের রেকর্ড৷
মহানায়ক উত্তমকুমার নিজের মুখে বলেছেন 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবিতে তাঁর বিপরীতে রমাকে পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর নায়িকা এসে গিয়েছে৷ সেটা ভাল করে বোঝা গেল 'অগ্নিপরীক্ষা' ছবির পর। তারপর তো তাদের দু'জনকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি, বাংলা ছবিতে রোম্যান্টিসিজিমের নতুন ধারার প্রবর্তন হয়েছিল উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে ঘিরেই ৷
উত্তমকুমার শুধু এটুকু জানতেন গান জানলেই নাকি সহজে সিনেমায় সুযোগ পাওয়া যায়! তখন তাঁর কতই বা বয়স হয়তো ম্য্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন৷ অথচ মনে সেই বয়সে সিনেমার প্রতি প্রবল উৎসাহ৷ কানন দেবী, কে এল সায়গল, পাহাড়ি স্যান্যাল, রবীন মজুমদার, অসিতবরণের সঙ্গীত প্রতিভা, গায়কির ঢঙ, কণ্ঠস্বরে তিনি অনুপ্রাণিত, মনে মনে প্রতিজ্ঞা গান শিখবেন৷ গিয়েছিলেন নিদান ব্যানার্জির কাছে, তখন কণ্ঠশিল্পী ও সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে বেশ নাম ডাক৷ তাঁর কাছে শিখতে লাগলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত৷ তিনিই বলেছিলেন প্রতিদিন গলা সাধা আর গানের সাধনা করলে উত্তমকুমার বড় সঙ্গীত শিল্পী হতে পারেন৷ বন্ধুমহলে অল্পদিনে গায়ক হিসেবে নাম করে ফেলেছেন৷ ১৯৪৫ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জন্মদিনে প্রভাত ফেরীতে নিজের রচিত, ও সুর দেওয়া গান নিজেই গেয়েছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার 'সুভাষেরই জন্মদিনে গাইব নতুন গান সেই সুরেতে জাগবে মানুষ জাগবে নতুন প্রাণ৷'
মাঝে অনেক সংগ্রামের পর নায়ক হিসেবে তখন তিনি প্রতিষ্ঠিত, শত ব্যস্ততার মাঝে ভুলে যান নি গান, অবসর পেয়েছেন মেতে উঠেছেন নিজের গানের চর্চায়৷ সহধর্মিনীর অনুপ্রেরণা ছিল গানটা যেন তিনি না ছাড়েন৷ সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলা ছবিতে প্লে-ব্যাক করেছিলেন, দেবকীকুমার বসু পরিচালিত 'নবজন্ম' ছবির নেপথ্যে গাওয়ার অফার পেয়ে প্রস্তাবে রাজি হতে বিন্দুমাত্র সময় নিলেন না, নচিকেতা ঘোষ ছিলেন ছবির সুরকার, তাঁর সুরে ওই ছবিতে তিনি গেয়েছেন ছয়টি গান তার মধ্যে 'কানু কহে রাই, কহিতে ডরাই'। গানে উত্তমকুমারের সঙ্গীত প্রতিভার যতেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়৷
মহানায়িকা সুচিত্রা সেন অবশ্য অভিনয় জীবন শুরু করার আগে গায়িকা হিসেবে নিজেকে জনসাধারণের কাছে পরিচিত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভাগ্য তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অভিনয়ের দিকে৷ ১৯৫৯ সালে আবার নতুন করে মেগাফোন চালুর কথা ভাবা হচ্ছে, চারিদিকে সাড়া পড়ে যায় এমন কিছু দরকার, তখন কমল ঘোষের মাথায় এলো সুচিত্রা সেন কে দিয়ে আধুনিক বাংলা গান গাওয়ানোর কথা, পুজোর গানের জন্য মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের গাওয়া গানের রেকর্ড বের করেছিল মেগাফোন কোম্পানি, কথা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর রবীন চট্টোপাধ্যায়, কণ্ঠ সুচিত্রা সেন৷
মহানায়িকা তখন খ্যাতির মধ্যগগনে, মুক্তি পেয়েছে 'চাওয়া পাওয়া' আর 'দ্বীপ জ্বেলে যাই', দুটো ছবি সুপারহিট কিন্তু স্বামীর বন্ধু কমল ঘোষের কোম্পানির যদি উপকার হয় সেই ভাবনা থেকেই সুচিত্রা সেন রেকর্ড করতে রাজি হলেন৷ গান লেখার দায়িত্বে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর দেবেন রবীন চট্টোপাধ্যায়, গাইবেন বাংলা ছবির সর্বকালের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। সব মিলেমিশে একটা অন্য ব্যাপার হবে সেই নিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলেন কমল ঘোষ৷ রেকর্ডিংয়ের আগে বেশ কিছুদিন নিয়মিত রিহার্সাল করেছেন সুচিত্রা সেন, ঘড়ি ধরে আসতেন কমল ঘোষের বাড়িতে, রিহার্সাল চলত টানা দুই-তিন ঘন্টা৷
সুচিত্রা সেনের ওই রেকর্ডটির নম্বর -জে এন জি ৬০৫০৷ দু'পিঠে দুটো গান প্রথম গান— 'আমার নতুন গানের নিমন্ত্রণে, আসবে কি?/ আমায় তুমি আগের মতো তেমনি ভালোবাসবে কি?' দ্বিতীয় গানের কথা ভারি সুন্দর— 'বনে নয় আজ মনে হয় যেন রঙের আগুন প্রাণে লেগেছে/ প্রাণে প্রাণে গানে গানে/ ফাগুনে আগুন বুঝি লেগেছে/ একি দোলা প্রাণে'৷
এত যত্ন করে সুচিত্রা সেনের বাংলা গানের যে রেকর্ডটি বের করেছিল মেগাফোন, প্রচণ্ড চাহিদা থাকা সত্বেও বাজার থেকে সেটি তুলে নেওয়া হয়েছিল৷ কোম্পানির বক্তব্য রেকর্ডের কারিগরি কিছু ক্রুটি বিচ্যুতির জন্য এই কাজটি করতে হয়েছিল, গানের শ্রোতারা মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের সুরেলা কণ্ঠে গাওয়া দুটি গান শোনা থেকে বঞ্চিত হলেও কোম্পানি চেয়েছিল ব্যাপক প্রচার, মেগাফোন কোম্পানি সুচিত্রা সেনের গানের রেকর্ডে সেই প্রচার পেয়ে যায়৷
প্রতিবেদন- অরুণাভ সেন
গ্রন্থঋণ-যেজন আছেন নির্জনে, সুমন গুপ্ত; আমার আমি, অনুলেখক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ
Post a Comment