হেরিটেজ তকমা পাচ্ছে প্রসিদ্ধ শিল্পী গোপেশ্বর পালের স্টুডিও
কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির প্রসিদ্ধ মৃৎশিল্পী পরিবারে তাঁর জন্ম৷ তিনি ছিলেন কুমোরটুলির প্রসিদ্ধ শিল্পী গোপেশ্বর পাল। মাতুল লব্ধপ্রতিষ্ঠ মৃৎশিল্পী সতীশচন্দ্র পালের কাছে তাঁর মৃৎশিল্পের অনুশীলনের সূত্রপাত। মৃন্ময়মূর্তি রচনা থেকে ক্রমে প্রস্তরমূর্তি প্রস্তুত করতে তিনি আরম্ভ করেন। পরিণত জীবনে তিনি দেবমূর্তি গড়ায় পারদর্শী হন। প্রায় ২০ বছর বয়সে জীবিকার সন্ধানে রাণীগঞ্জে বার্ণ কোম্পানির পটারী ওয়ার্কর্সে ২৫ টাকা মাইনেয় চাকরি নেন। অল্প কয়েকদিনেই প্রতিমা গড়ে সকলকে চমৎকৃত করেন। রাণীগঞ্জেই শিল্পীজীবনের সাফল্যের সূত্রপাত হয়। তিনি চাকুরি ছেড়ে শিল্পশালা গড়ে তুলে প্রতিমা ও মূর্তি গড়া শুরু করেন।
১৯১৫ সালে ছোটলাট লর্ড কারমাইকেল ঘূর্ণীতে এলেন। তাঁর কানে পৌঁছল গোপেশ্বরের অসাধারণ ক্ষমতার কথা। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস করলেন না তিনি, কিন্তু ঘোর ভাঙল যখন কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোপেশ্বর তাঁর সামনেই তৈরি করে দিলেন দুর্গাপুজোর কিছু মুহূর্তের অসাধারণ জীবন্ত ছবি৷ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে কারমাইকেল তাঁকে অভিহিত করলেন "The Lightening Sculptor" বলে, যাঁর হাতে সাধারণ মাটির তাল নিমেষের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায় এক অপরূপ শিল্পমন্ডিত মূর্তিতে৷
গোপেশ্বর পাল নিজের প্রতিভার জোরে সুখ্যাতি অর্জন করতে লাগলেন৷ গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউনের উদ্যোগে ১৯২৪ সালে তিনি পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ডে এক শিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নিতে। জাহাজে শিল্পচর্চার প্রধান উপকরণ হিসেবে তিনি নিয়ে গেলেন দু ব্যারেল ভর্তি এখানকার মাটি। শিল্প প্রদর্শনীতে হাজির হলেন রাজা পঞ্চম জর্জ ও রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। তাঁদের সকলের সামনে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে কুকুর, ৪৫ সেকেন্ডের মধ্যে ছুটন্ত ঘোড়ার প্রতিমূর্তি বানালেন তিনি। সবশেষে মাত্র কয়েক মিনিটে রাজা পঞ্চম জর্জের মাটির মূর্তি বানিয়ে সাড়া জাগালেন তিনি। এ কী করে সম্ভব? বিস্ময় জাগে এখানেই। লন্ডনের বুকে কয়েক মিনিটের মধ্যে এক রাজার মূর্তি গড়ে অবাক করে দেন তিনি।
সম্প্রতি গোপেশ্বর পালের স্টুডিওকে হেরিটেজ স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। তাঁর হাতে গড়া স্টুডিওর সামনে বসবে নীল ফলক। তাঁর হাতে তৈরি রামকৃষ্ণের প্রস্তরমূর্তির সঙ্গে পরিচিত সকলেই। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেশনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সহ বহু খ্যাতনামা মানুষের মূর্তি গড়েছেন তিনি। গোপেশ্বর পালের মতো একজন মহান শিল্পীর স্টুডিওকে সম্মান জানানোয় খুশি তাঁর দৌহিত্র আশিস পাল এবং বর্তমানে স্টুডিওর দায়িত্বে থাকা ব্যোমকেশ পালও।
প্রয়াত এই শিল্পীর পরিবারের প্রস্তাব মেনে এবার সেখানে সংগ্রহশালা তৈরি করবে রাজ্য সরকার। এই প্রসঙ্গে হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের বক্তব্য, "গোপেশ্বর পাল অসাধারণ মৃৎশিল্পী ছিলেন। তিনি কাউকে একবার দেখে মিনিটের মধ্যে অবিকল তাঁর মূর্তি তৈরি করতে পারতেন, হাতে যেন জাদু ছিল৷ ওনার স্টুডিওকে এবার হেরিটেজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে তাঁর স্টুডিওকে সংগ্রহশালা করা হবে।"
প্রতিবেদন- নিজস্ব সংবাদদাতা
Post a Comment