ভ্রমণ ও ভক্তি কথায় কামারপুকুর || তৃতীয় পর্ব
কামারপুকুর মঠের ঠিক উল্টোদিকে বেশ বড় একটা পার্কিং লট আছে, সেখানে গাড়ি রেখে মঠের ভিতরে ঢোকা যায়। মঠের খোলাবন্ধের সময় গেটে লাগানো বিজ্ঞাপনে দেখে নিয়ে ছিলাম-এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর ভোর ৫:৩০ থেকে বেলা ১১:৩০ পর্যন্ত ও বিকেল ৪ টে থেকে রাত ৮:৩০ পর্যন্ত। অক্টোবর থেকে মার্চ সকাল ৬ টা থেকে বেলা ১১:৩০ পর্যন্ত ও বিকেল ৩:৩০ থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত।
ঠাকুর মন্দিরের গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকার সময়ে একটা আমগাছ দেখা যায়, যেটা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের লাগানো। এই গাছ যেমন বেঁচেও আছে, তেমনি আজও ফল দিয়ে চলেছে। এ গাছটা এখন মানুষের কাছে একটা ধর্মীয় জিনিস, এর গায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে লোকজন পুণ্য সঞ্চয় করে। মঠ কর্তৃপক্ষ তাই এর পাশে একটা লোহার জাল লাগিয়ে দিয়েছে যেটা ভেদ করে গাছের গায়ে হাত দেওয়া কিছুটা কষ্টসাধ্য। এছাড়া গাছে হাত না দেবার বিজ্ঞাপনটিও আমাদের চোখে পড়ল।
ঠাকুরের লাগানো আমগাছ |
আমরা আগেভাগে ঠিক করে নিয়েছিলাম ঠাকুরের সন্ধ্যা প্রার্থনায় যোগ দেবো। সে প্রার্থনা শুরু হতে আরও আধ ঘন্টার মত বাকি আছে। তাই ঠিক করে নিলাম মন্দিরের পাশটিতে তদানীন্তন ঠাকুর ও ঠাকুর পরিবারের বাসগৃহ, কুঁড়েঘরগুলি দেখে নেব।
আগেকার দিনে গ্রামবাংলায় যেরকম বাড়ি দেখা যেত, একেবারে সেই রকম। খড়ের চাল দিয়ে ঢাকা মাটির কুঁড়েঘর। এ রকম কয়েকটা কুঁড়েঘর আর মাঝখানে উঠোন নিয়ে ছিল রামকৃষ্ণের পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি। কামারপুকুর প্রাঙ্গনের পশ্চিম দিকের দক্ষিণ মুখী ঘরে ঠাকুর বাস করতেন, বর্তমানে সেটি মন্দির প্রাঙ্গনের একটি অংশ। একদা ঠাকুর মা সারদা মাকে বলেছিলেন "আমার মৃত্যুর পরে, তুমি কামারপুকুরে থাকবে, সবুজ শাক সব্জী চাষ করবে, সহজ ভাবে জীবন যাপন করবে এবং ঈশ্বরের নাম নিয়ে তোমার দিন কাটাবে।"
ঠাকুরের থাকার ঘরের পাশের কুটিরে ঠাকুরের মধ্যম ভ্রাতা রামেশ্বর তার পুত্র কন্যা নিয়ে বাস করতেন। এই কুঠিটি দ্বিতল। বর্তমানে এই দ্বিতল কুঠিটি মন্দিরের ভাড়ারঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঠাকুরের বাসগৃহটি যথাযথ ভাবে একই রকম রেখে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই গৃহে ঠাকুরের একটা প্রতিকৃতিও রাখা আছে।
দ্বিতল ঘরটির পাশে বর্তমানের ভাঙাচোরা ঘরটি আসলে ছিল ঠাকুর পরিবারের গোশালা। সামান্য দূরে গোশালা সংলগ্ন মাঠটির এক কোনায় দেখতে পাচ্ছিলাম ঠাকুরের লাগানো সেই আম গাছটিকে। ঠাকুরের ঘরে প্রবেশ নিষেধের একটি বিজ্ঞাপন লাগানো ছিল। আমরা তার পাশের ঘরটিতে দু-এক জন শিষ্য সম্প্রদায়ের লোককে দেখতে পেলাম। তারা স্বামীকে কিনা বলতে পারব না হতে পারে স্বামীজি পর্যায়ে এখনো তারা উন্নীত হন নি, তাই তাদের পরনের পোশাক সাদা। ঘরটিতে কি আছে জেনে নেবার একটা কৌতুহল সামলাতে পারছিলাম না। ঘরটিতে প্রবেশ নিষেধের কোনরকম জানান দেওয়া ছিল না। এমতাবস্থায় আমি দুটো সিঁড়ি ডিঙিয়ে ঘরের উঠোনে পা রাখলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে সাদা পোশাক পরা শিষ্য সম্প্রদায়ের হবে একটা ছেলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে আমায়, দূর দূর, করে উঠলো। আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে লাফ দিয়ে নিচে নেমে এলাম। ছেলেটা ঘর থেকে বোধহয় গঙ্গাজল এনে আমার অপবিত্র পায়ের ছোঁয়াটুকু জলে ধুয়ে মুছে নিলো। আমি এ ঘটনাটা সাধারণ ভাবে নিতে পারলাম না। কেন এই ভ্রান্ত ধারণা আজও রামকৃষ্ণ মঠের শিষ্যদের মাঝে থেকে যাবে? এমনটা আমার ধারণারও বাইরে ছিল। রামকৃষ্ণের বই, চলচ্চিত্র দেখে যে ভাবধারা আমার মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল এই ঘটনাটা বৈপরীত্য আমার মনে ধাক্কা দিয়ে গেলো। আমার মনে হল, এমনটা কি হবার ছিল ? এখনও সন্ন্যাসী শিষ্যদের মনে বিভেদের এমনি বেড়াজাল থেকে গেছে ! হঠাৎ ঘটে যাওয়া একটা অপমানবোধ মনটাকে বার বার নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। তবে জানি না, কতটা নিরপেক্ষতার বিচারে আমি এই কথাগুলো ব্যক্ত করলাম। তবে আমার মন খারাপটুকু আমি প্রকাশ না করে পারলাম না।
মঠ পরিসরের মধ্যে যে সব মন্দির, দেবস্থান ও ভবননাদি রয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরলাম--
ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের আবির্ভাব এবং তার শিষ্য গুরুজনদের ও ভক্তদের এই পুণ্য স্থানে যাতায়াতের জন্য এই স্থানটি তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত বর্ষ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ভক্তবৃন্দ আসেন এই স্থান পরিদর্শনের জন্য আসেন এবং নিজেদের আধ্যাত্বিক উন্নতি ঘটান।
রঘুবীরের মন্দির : কামারপুকুরের রঘুবীর ঘরটি ছিল পূর্বমুখী খড়ের ছাউনি আটা ঘরটির মেঝে এবং দেয়াল ছিল মাটির। বর্তমানে রঘুবীরের মন্দিরটি ওই একই স্থানে একই পরিমাণ জায়গায় অবস্থান নিয়ে তৈরি হয়েছে।এই মন্দিরে রঘুবীরের শালগ্রাম শিলা মা শীতলার মাটির ঘর রামেশ্বর শিব লিঙ্গ নারায়ন শালগ্রাম শিলা এবং একটি গোপালের চিত্র প্রতিদিন পূজিত হয়। ঠাকুরের বাসগৃহের সামনে এই মন্দিরটি অবস্থিত। এছাড়া ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী লক্ষ্মীদেবীর গোপাল ও নারায়নশীলের পুজোর ব্যবস্থা রয়েছে। ঠাকুরের উপনয়নের পর ঠাকুর এখানে রঘুবীরের পুজো করেছিলেন। বর্তমানে এই মন্দিরটি রামেশ্বরের বংশধরগণের তত্ত্বাবধানে আছে। তারাই এখানকার পূজার্চ্চনা করে থাকে। মঠ থেকে পূজা ও ভোগের সব সামগ্রী দেওয়া হয়।
রঘুবীরের মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেব-দেবী |
এছাড়া পাশেই রয়েছে লক্ষীজলা। এখানকার জমিটিকে ভিত্তি করেই কামারপুকুর গ্রামে ক্ষুদিরামের বসবাসের সূচনা হয়েছিল। হালদারপুকুরের পশ্চিমদিকে জমিটির অবস্থান। ক্ষুদিরাম এই জমিতেই চাষবাস আরম্ভ করেছিলেন। বর্তমানে মঠের কৃষিবিভাগ এই জমিতেই চাষ করে। এখানকার ধানেই আজও রঘুবীরের সেবা হয়ে থাকে।
ঠাকুরের ঘরের উত্তর দিকে যোগীর শিব মন্দির। একবার এই মন্দিরের সামনে ঠাকুরের মা ধাত্রী মা ধনী ঠাকুরানীর সাথে কথা বলছিলেন, এমন সময় হঠাৎ শিবের মূর্তি থেকে একটি আলো আর্বিভূত হয় সেই আলোকে গোটা মন্দিরটি আলোকিত হয়ে ওঠে এবং আলোটি দ্রুত তাঁর শরীরে প্রবেশ করে। আশ্চর্যে, ভয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন, যখন তাঁর জ্ঞান আসে তখন তিনি অনুভব করেন সেই আলোটি তাঁর গর্ভে তখনও রয়েছে এবং তিনি গর্ভ ধারণ করেছেন। ফলস্বরূপ গদাধরের জন্ম।
যোগীর শিব মন্দির |
প্রার্থনার সময় এগিয়ে আসছিল। প্রার্থনা সংগীত আর একটু পরেই শুরু হবে। মন্দির প্রাঙ্গণে ঠাকুর বিগ্রহের ঠিক সামনের চত্বরে সিমেন্ট বাঁধানো জায়গাটিতে ভক্তদের বসার জন্য শতরঞ্চি পাতা হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ভক্ত নিজেদের আসন অধিকার করে বসে আছেন। আর দেরি করা যাবে না, আমি ও আমার স্ত্রী এগিয়ে গেলাম--পুরুষ স্ত্রী বিভাজন ব্যবস্থা এখানেও আছে। স্ত্রী এগিয়ে গিয়ে জায়গা নিয়ে বসলেন। সামনের দিকে পুরুষদের বসার ব্যবস্থা রাখা ছিল, আমি সেখানে গিয়ে বসলাম। একটু পরেই দেখলাম স্বামীজীরা এলেন, প্রার্থনার শুরু করার প্রস্তুতি চলছে। সামনে হারমোনিয়াম আর আছে অডিও যন্ত্র সঙ্গীতের আয়োজন। শুরু হল প্রার্থনা গীত--
খন্ডন-ভব-বন্ধন, জগ-বন্দন বন্দি তোমায়।
নিরঞ্জন, নবরূপধর, নির্গুণ গুণময়।.
মোচন-অঘদূষণ, জগভূষণ, চিদ্ঘনকায়।
জ্ঞানাঞ্জন-বিমল-নয়ন, বীক্ষণে মোহ যায়….
আমি নাস্তিক প্রকৃতির লোক, স্ত্রী আসলে অসত্য কিছু বলেন না। তা না হলে আমি দীক্ষা গ্রহণের একটা বছর পর করে দিয়েও কেন প্রার্থনাগীত আয়ত্ত করে উঠতে পারলাম না ! নিজের অসমর্থতার জন্য লজ্জিত হতে পারিনি বরং গলায় সুর মেলাবার অকৃত্রিম প্রয়াসে নিজের লজ্জাকে ঢেকে রাখার প্রয়াস করছি। তবু কেন যেন ভালো লাগছিল, মনে হচ্ছিল পবিত্র একটা ভাবনা চারদিকের আকাশে বাতাসে বাইরের আঁধারে সর্বত্র যেন মিলে মিশে গেল। মনে মনে ভেবে নিলাম ঠাকুরের প্রার্থনা গীত, ভক্তি গীত আমি অবশ্যই আয়ত্ত করে নেব। ঠাকুর ও মাকে অন্তরে ধারণ করতে না পারলে যে আমার দীক্ষা গ্রহণ বৃথা হয়ে যাবে। মনে ভেসে আসছিল প্রার্থনা গীতের শেষ দুটি লাইন--
জয় জয় আরতি তোমার, হর হর আরতি তোমার,
শিব শিব আরতি তোমার। --
এই প্রার্থনাগীতটি স্বামী বিবেকানন্দের লেখা।
প্রধান মন্দির চত্বর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সামনে লম্বা রাস্তা চলে গেছে মঠের অফিস ঘর পর্যন্ত। মাঝ পথের বাঁদিকে রয়েছে মঠের পুস্তক বিপণি। ধার্মিক বই, বিশেষ করে ঠাকুর ও মাকে নিয়ে লেখা সমস্ত পুস্তক সম্ভার এখানে কিনতে পাওয়া যাবে। পুস্তকালয়ের পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে ভোগ ব্যবস্থা, ভান্ডার গৃহের দিকে। এখানে আছে ভোগ পরিবেশনের জন্য বিশাল এক ঘর। বসা খাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে এখানে। এর পাশটিতে স্বামীজীদের থাকার জন্য আছে বড় একটি আবাস অট্টালিকা। তার সামনে রয়েছে প্রশস্ত এক ময়দান। এছাড়া বেশকিছু ফুল বাগান ও ছোট বড় বাগ বাগিচা মঠের স্থানে স্থানে সুসজ্জিত রয়েছে।
Post a Comment