পথের পাঁচালী : ২৬ শে আগস্ট ১৯৫৫, মুক্তির আগে থেকেই জনপ্রিয়
২৬ শে আগস্ট, ১৯৫৫। ঠিক এই দিনটিতে মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিৎ রায় পরিচালিত 'পথের পাঁচালী'। ৬৬ বছর হয়ে গেল, এখনও লোকমুখে শুনতে পাই মুক্তির পর বেশ কয়েক মাস ছবিটি নাকি কেউ দেখতে যায়নি। ফাঁকা হলে মাছি তাড়াতো। বিদেশ থেকে, মানে কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে প্রাইজ পাবার পর, বিদেশে সমাদৃত হবার পর বাঙালিরা ছবিটি দেখতে হলে যেতে শুরু করে। তারপর ছবিটি জনপ্রিয় হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রায় বছর চল্লিশ ধরে বিভিন্ন লেখায়, বক্তৃতায় প্রমাণসহ বলে যাচ্ছি এ কথাটি ঠিক নয়, ভুল, সে কথা কেউ শুনতেই চায় না। মুক্তি পাবার পর নয়, আগে থেকেই 'পথের পাঁচালী' নিয়ে সাধারণ বাঙালির মধ্যে বেশ একটা আলোড়ন উঠেছিল। সে সব নিয়ে আজ থেকে ঠিক ৩৮ বছর আগে 'এক্ষণ' পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় একটা নিবন্ধ লিখি। সেই লেখায় ১৯৫৫ সালের সংবাদপত্রের খবর তুলে তুলে দেখিয়েছিলাম, কিভাবে বাঙালির মধ্যে এই ছবিটি নিয়ে আলোড়ন হয়েছিল।
'পথের পাঁচালী' নিয়ে কাগজে প্রথম খবর বেরিয়েছিল মুক্তির এক বছর আগে। ১৯৫৪ সালের ৭ ই মে আনন্দবাজার পত্রিকায় দেখা যায় ছবিটি নিয়ে প্রথম খবর। লেখা হয়, 'বিশেষ সূত্রে জানতে পারা গেল পশ্চিমবঙ্গ সরকার পথের পাঁচালী ছবিখানি তোলা সম্পূর্ণ করার জন্যে ছবিখানির প্রযোজক সত্যজিৎ রায়কে আনুমানিক ষাট হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করবেন বলে ঠিক হয়েছে।'
তখনও কিন্তু চুক্তি সই হয়নি। সবে কথা হয়েছিল মাত্র। সে খবর আগেই প্রকাশ হয়ে যায়। চুক্তি সই হয়েছিল এর ঠিক তেরো দিন পর। এরপর থেকেই মাঝে মাঝে খবর দেখা যেত, শুটিং চলছে বলে। ছবির শুটিং শেষ হলো। ১৯৫৫ সালের গোড়ায় এডিটিংয়ের কাজের মধ্যেই রবিশংকর এলেন মিউজিক করতে। কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁকে অনুষ্ঠান করতে বাইরে চলে যেতে হবে। টালিগঞ্জের ভবানী সিনেমায় ছবির অর্ধেক, মোটামুটি ৭ রিল ছবি দেখানো গেল রবিশংকরকে। সেখান থেকে সোজা টেকনিসিয়ান্স স্টুডিওতে। একটানা ১১ ঘন্টা ধরে চললো মিউজিক রেকর্ডিং।
ইতিমধ্যে মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের ডিরেকটর, মনরো হুইলার কলকাতায় এসেছিলেন ভারত উৎসবের জন্যে কিছু পেইন্টিং নিয়ে যেতে। তিনি হঠাৎ 'পথের পাঁচালী' ছবির কয়েকটি স্টিল দেখে আগ্রহী হয়ে উঠে সত্যজিতকে বলেন, ছবিটি শেষ হলে তিনি মে মাসের ইণ্ডিয়া ফেস্টিভ্যালে সেটি দেখাতে চান। কোনক্রমে শেষ করে ছবিটা সেখানে পাঠানো হয়। সেটা ছিল ফেস্টিভ্যালের মধ্যে অন্য অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে দেখানো। এবং সেখানে একবার সাধারণ দর্শকের জন্যে এবং আরও একবার বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তার খবর আলাদা করে প্রকাশিত না হলেও কলকাতার আগ্রহী লোকেদের কাছে সে খবর পৌঁছে গিয়েছিল।
১৯৫৫ র ১৭ ই জুলাই সরকারের পক্ষে কাগজে একটা ছোট্ট বিজ্ঞাপন বেরোয়, "পথের পাঁচালী' যে যে প্রযোজকেরা দেখাতে চান, তাঁরা যেন প্রচার অধিকর্তার সঙ্গে দেখা করেন।"
এই বিজ্ঞাপনটি দেখে কাগজে তীব্র সমালোচনা করে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এটা উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, ছবিটির বিষয়ে মানুষ কতটা আগ্রহী ছিল, সেটা বোঝাতেই। সেই জুলাই থেকেই বিভিন্ন কাগজে ছবিটি নিয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে।
ছবি মুক্তি পাবার আগেই দৃষ্টিসুখ হোর্ডিং কিংবা এক সপ্তাহ আগে থেকে কাগজের বিজ্ঞাপন ছিল, যাকে বলে 'টক অফ দ্য টাউন'। মুক্তির পরের সপ্তাহে কাগজে লেখা হয়েছে, "সারা শহরকে মুখর করে রাখায় পথের পাঁচালী একটা প্রায় রেকর্ডই সৃষ্টি করে যাচ্ছে। রেস্তোরাঁয়, কফি হাউসে, বৈঠকখানায় বা কোথাও কোনরকম আড্ডা হলেই সর্বত্রই ঐ একই বিষয় নিয়ে আলোচনা। ছবির হোতা পশ্চিমবঙ্গ গভর্নমেন্ট থেকে ভালোভাবে প্রচার ব্যবস্থা আশা করা গিয়েছিল, কিন্তু এ বিষয়ে প্রচার বিভাগ আগেও যেমন অনড় ছিল এখনও তেমনই নির্লিপ্ত।" অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে প্রচারের মুখ্যভাগ ছিল মানুষের মুখে মুখে প্রচার।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরই এক হিসেব থেকে জানা যায়, মুক্তির প্রথম ১৯ দিনে, অর্থাৎ ২৬ শে আগস্ট থেকে ১৩ ই সেপ্টেম্বর, সব রকম খরখরচা বাদ দিয়ে সরকারের মোট লাভ হয়েছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার ৯১৭ টাকা ৫০ পয়সা। মনে রাখবেন সালটা ১৯৫৫। আর হ্যাঁ, পরিচালক হিসেবে সত্যজিৎ রায় পেয়েছিলেন সব মিলে ৩ হাজার টাকা।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, কান ফেস্টিভ্যালের খবর কলকাতার কাগজে বেরোয় পরের বছর ১৯৫৬ র ১১ ই মে। ততদিনে 'পথের পাঁচালী' বি এফ জে এর বিচারে বছরের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় ছবির পুরস্কার ছাড়াও আরও ৬ টি বিভাগে শ্রেষ্ঠ বলে নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিল।
প্রতিবেদন- দেবাশিস মুখোপাধ্যায়
Post a Comment