প্রথম এশিয়ান হিসেবে মিস্টার ইউনিভার্স জিতেছিলেন মনোতোষ রায়
কেবল বুদ্ধিবিদ্যাই নয়, পেশীর জোর ও বডিবিল্ডিং-এও এগিয়ে বাঙালিরা। এই প্রতিবেদনে এমন একজন বডিবিল্ডারের কথা বলবো যাকে সকল বাঙালিই চেনেন৷ যিনি প্রথম এশিয়ান হিসেবে মিস্টার ইউনিভার্স জিতেছিলেন। তিনি হলেন প্রখ্যাত বডিবিল্ডার মনোতোষ রায়। তাঁর আরেকটি পরিচয় হলো তিনি আটবার ভারতশ্রী ও অর্জুন পুরস্কারপ্রাপ্ত আরেক বিখ্যাত বডিবিল্ডার মলয় রায়ের পিতা। মলয় রায় যাকে লোকে গুণময় বাগচি নামেই বেশি চিনতেন। 'জয় বাবা ফেলুনাথ' ছবিতে মলয় রায় গুণময় বাগচির ভূমিকায় অভিনয় করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সেই থেকে আপামর বাঙালির কাছে তিনি গুণময় বাগচি হয়েই থেকে যান।
১৯৩৯ সালে তিনি প্রথম বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন কিন্তু তাতে তিনি ব্যর্থ হন। তবে তিনি এতটুকুও ভেঙে পড়েননি। তখনও বিশ্বশ্রী হওয়ার স্বপ্ন ভাসছে তাঁর দু'চোখে৷ এরপর তিনি প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন মিস্টার ইউনিভার্স বা বিশ্বশ্রী হওয়ার জন্য। দিনরাত দৃঢ়সংকল্পের সাথে কঠোর অনুশীলন চালিয়ে যান তিনি। ঐ বছরই ইস্ট ইন্ডিয়ান বডিবিল্ডিং চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি জয়ী হলেন। এরপর দীর্ঘ আটবছর পর ১৯৪৭ সালে অল ইন্ডিয়া বডিবিল্ডিং চ্যাম্পিয়নশিপেও জয়ী হলেন।
১৯৫১ সালে বাংলার গৌরব মনোতোষ রায় ব্রিটেন পাড়ি দেন গ্রুপ থ্রি অ্যামেচার বিভাগে মিস্টার ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার জন্য, তিনি বাঁধার হিমপ্রাচীর ঠেলে সফল হলেন। বুকের মধ্যে পুষে রাখা স্বপ্ন সত্যি হলো তাঁর৷ স্বাধীনতার পর ইংরেজদের মাটিতে প্রথম বাঙালির জয়ের নিশান উড়লো মনোতোষ রায়ের হাত ধরে। তাঁর সুগঠিত পেশীবহুল চেহারা দেখে খোদ ব্রিটেনের লোকজনই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওঠে। বহু মানুষ আড়াই ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করতে থাকে তাঁর একটি অটোগ্রাফের জন্য। বিরল এই খেতাবটি জয়ের পর ইন্ডিয়া হাউসে ভারতীয় হাই কমিশনার তাঁকে সম্মান জানিয়েছিল।
মাত্র ১২ বছর বয়সে শরীরচর্চা শুরু করেন তিনি। মনে মনে ব্যায়ামাচার্য বিষ্ণুচরণ ঘোষকে গুরু পদে বরণ করেছিলেন। বিষ্ণুবাবুর ছবি সামনে রেখে চালিয়ে যেতেন যোগব্যায়াম। বিষ্ণুচরণ ঘোষও তাঁকে একসময় ছাত্র বানিয়ে নেন। ব্যায়াম ও হঠযোগের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তখনকার স্বাস্থ্য-সচেতন তরুণদের আইকন হয়ে উঠেছিলেন বিষ্ণুচরণ ঘোষ। তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। গুরু হিসেবে বিষ্ণুচরণ ঘোষকে তিনি যথেষ্ট সম্মান দেন। বিশ্বশ্রী হয়ে বিষ্ণুচরণ ঘোষের যোগ্যতম ছাত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন তিনি।
১৯৫১ সালে আরো একবার মিস্টার ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন তিনি৷ আবারো বিশ্বশ্রী হলেন তিনি। এই নিয়ে দু'বার মিস্টার ইউনিভার্স চ্যাম্পিয়ন হলেন তিনি। সারা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে ওঠে তাঁর পেশীবহুল চেহারাতে। একজন বাঙালি হিসেবে ব্রিটেনের মাটিতে বিশ্বশ্রী হওয়া সেকেলে বাংলার তরুণসমাজকে বেশি বেশি করে বডিবিল্ডিং-এ উদ্বুদ্ধ করেছিল। মিস্টার ইউনিভার্স খেতাব জয়ের পর দেশে ফিরে এলেন তিনি৷ তারপর বিভিন্ন ফিজিক্যাল কালচার ক্লাবে প্রশিক্ষক হিসেবে নতুন অধ্যায় শুরু করেন। এমনকি বিভিন্ন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বদের তিনি যোগ ব্যায়াম ও ফিটনেস বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন।
১৯৫৮ সালে মনোতোষ রায় প্রতিষ্ঠা করলেন ইন্ডিয়ান বডিবিল্ডিং ফাউন্ডেশন। এশিয়ান বডিবিল্ডিং ফেডারেশনেরও তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৯৮ সালে তাঁর নিজের বাড়ির কাছেই তৈরি করলেন এক মাল্টিজিম৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ল কলেজে তিনি শিক্ষকতাও করেছিলেন৷ বিভিন্ন সাময়িক পত্র পত্রিকায় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রবন্ধ লেখালেখি করতেন তিনি৷ যোগ ব্যায়ামের ওপরও তিনি অনেক অনেক বই লিখেছিলেন৷ দূরদর্শনেও ওনার যোগ ব্যায়াম নিয়ে অনুষ্ঠানের সম্প্রচার হয়েছিল। কলকাতার বিভিন্ন স্থানে তিনি যোগকেন্দ্রও গড়ে তুলেছিলেন।
২০০১ সালে ইন্টারন্যাশনাল বডিবিল্ডিং ফেডারেশনের তরফে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টের জন্য তাঁকে ভূষিত করা হয় স্বর্ণপদকে।
তথ্যসূত্র- দ্য ইন্ডিয়ান অ্যাটলাস, বঙ্গদর্শন, ব্যায়ামে বাঙালি : অনিলচন্দ্র ঘোষ।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment