কলকাতার জন্মদিন! একটি কলোনিয়াল হ্যাংওভার ছাড়া কিছুই নয়!
খড়দহ, চুঁচুড়া, কলকাতা, দেগঙ্গা, নৈহাটি প্রভৃতি নদী বন্দর হয়ে ভেসেছিল এক বাণিজ্য তরী। সেই তরী চম্পক নগরের অধীশ্বরের। বিভিন্ন নদী ঘাট ছুঁয়ে যেতে যেতে কলকাতাকেও স্পর্শ করেছিলেন বণিক চাঁদ সদাগর। এমন কথাই লিপিবদ্ধ মনসামঙ্গল কাব্যে। এই নদী ঘাট, এই প্রান্তর, এই নগর জেগে আছে যুগ যুগ ধরে। কোন সাহেব সন্তানের পদস্পর্শ নয়, কোন বেনিয়া কোম্পানির আনুকূল্যে নয়, কোন সাম্রাজ্যবাদী রাজতন্ত্রের রসদ জোগাতে এই শহর সৃষ্ট নয়। কলকাতা জেগে আছে মঙ্গলকাব্যে, কলকাতা জেগে আছে বিপ্রদাসের কলমে, কলকাতা জেগে আছে নদী ঘাটের পলি মাখা ইতিহাসে, এই শহর জেগে আছে নাগরিক চেতনার গভীরে।
যারা আজও মনে করেন জোব চার্নক এই শহরের জন্মের সঙ্গে কোন ভাবে যুক্ত তাদের ভুল ভাঙার সময় এসেছে। ১৪১৭ শকাব্দ অর্থাৎ ১৪৯৫ -৯৬ খ্রিস্টাব্দ, যখন চার্নক সাহেবের প্রপিতামহেরও সম্ভবত জন্ম হয়নি সেই সময় মনসামঙ্গল কাব্যে কলকাতা বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ কলকাতা আবহমান সময়ের ধারায় তার পরিবর্তন হয়েছে। গ্রাম থেকে সে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে কল্লোলিনী। তাকে অনুভব করা যায়, তাকে নিজের পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত করা যায় কিন্তু নদী তটের উপর দিয়ে বয়ে চলা ইতিহাসকে ঐকিক নিয়মে হিসেব যাওয়া নিতান্তই অবিমৃষ্যকারী চেষ্টা।
একটা ভুল ধারনা বহুযুগ ধরে কলকাতাবাসীর মনে জাঁকিয়ে বসেছিল। ২৪ আগস্ট নাকি কলকাতার জন্মদিন! ভাবটা এমন ঐদিন টুপ করে রঙিন ব্রিটিশ প্যরাশুটে মাটি স্পর্শ করেছিল শিশু কলকাতা।অতঃপর তার কৈশোর কেটেছে ব্রিটিশের কোলে! যৌবনে সে কোম্পানির কেরানি অবশেষে অবসর নিয়ে শতিনেক বছর ধরে অমর হয়ে কংক্রিটের জঙ্গলে বানপ্রস্থ কাটাচ্ছে! কিন্তু বাস্তব ঘটনা একেবারেই এমন নয়।
২০০৩ সালে কলকাতা উচ্চ-আদালত সমস্ত দিক বিচার বিবেচনা করে রায় ঘোষণা করে জানিয়ে দিয়েছে কলকাতার কোন জন্মদিন নেই। কোন প্রতিষ্ঠাতাও নেই। কলকাতার এক সময়ের জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার প্রমাণ দিয়ে কোর্টকে বুঝিয়েছে জোব চার্নক আসার বহু আগেই কলকাতার অস্তিত্ব ছিল। অর্থাৎ না আছে কলকাতার কোন জন্মদিন না আছে কোন প্রতিষ্ঠাতা।
তাহলে এখনো ২৪ আগস্ট কলকাতার জন্মদিন বলে গুগুলে দেখা যায় কেনো? এই ভুল সংশোধনের জন্য গুগলকে চিঠি দিয়েছে রায়চৌধুরি পরিবারের সদস্যরা। আশা করা যায় ভুল শুধরে নেবে গুগুল।
কলকাতার জন্মদিন নিয়ে লাফালাফি কলোনিয়াল হ্যাংওভার ছাড়া কিছুই নয়। এই শহর গড়ে উঠেছে সময়ের সাথে, মানুষের হাত ধরে। যে মানুষ এই মাটির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, যে মানুষ এই মাটিকে ভালবেসেছে তার রক্ত -ঘাম দিয়ে, আপন করে নিয়েছে এই নাগরিক জনজীবনকে। আসলে শহরের কোন জন্মদিন হয় না, শহরের কোন প্রতিষ্ঠাতা হয় না। শহর চলমান সময়ের চালচিত্র, যা বদল হতে থাকে, পাল্টাতে থাকে অবিরত। দিন সাল, বয়সের ঐকিক নিয়মে শহরকে ধরা যায় না কখনই। যেমন ধরা যায় না কলকাতাকে। এই শহরের নাগরিক চেতনার গভীরে প্রতি সকালে নতুন জন্ম নেয় কলকাতা, প্রতি দিনই তার জন্মদিন। প্রতি মুহূর্ত সে সদ্যজাতের মতোই চঞ্চল, উদ্দাম প্রাণশক্তিতে উচ্ছল, কল্লোলিনী। বাংলার রাজধানী, বাঙালির প্রিয় শহর।
প্রতিবেদন- অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়
Post a Comment