চুঁচুড়ার অন্যতম ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী প্রাণকেন্দ্র ঘড়ির মোড়
হুগলি জেলার চুঁচুড়ার প্রাণকেন্দ্র হলো ঘড়ির মোড়। বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই মোড়। এর এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ইতিহাসের শহর চুঁচুড়াকে নিয়ে কবি অন্নদাশঙ্কর রায় এক মজার ছড়া লিখেছিলেন-- "হাঁসের প্রিয় গুগলি/ পর্তুগিজদের হুগলি/ গুণের প্রিয় তানপুরা/ ওলন্দাজদের চিনসুরা।" পর্তুগিজ, ওলন্দাজদের সময়কার নানা ইতিহাস যেমন এই শহরে রয়েছে তেমনই রয়েছে ব্রিটিশ শাসনকালের নানা স্মারক।
রাণী ভিক্টোরিয়ার জৈষ্ঠ্য পুত্র সপ্তম এডওয়ার্ড, যিনি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ৯ ই আগস্ট ব্রিটিশ সম্রাট ব্রিটেন ও ভারতের শাসনকর্তা হিসেবে অভিষিক্ত হন। তাঁর শাসনকাল ছিল মাত্র ৯ বছর। ১৯১০ সালে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তারপর তাঁর স্মারক হিসেবে চুঁচুড়া শহরের কেন্দ্রস্থলে চারমাথা মোড়ে একটি ক্লক টাওয়ার বা ঘড়ির মিনার নির্মিত হয়েছিল। সেই সুন্দর টাওয়ারটির জন্য এই মোড়টির নামকরণ করা হয় 'ঘড়ির মোড়'।
ঘড়িটির ঢালাই লোহার স্তম্ভের চতুর্দিকে রয়েছে ঘড়ির চারটি ডায়াল। যার ওপরে রয়েছে একটি ধাতব ঘন্টা। ঘড়ির মূল যন্ত্রাংশ পিতল ও ইস্পাতের। এছাড়া স্তম্ভটির গায়ে একটু নীচে উত্তর মুখে রয়েছে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের অবয়বের একটি ধাতব পার্শ্বমূর্তি। বাকি তিন দিকে রয়েছে তিনটি কারুকার্য খচিত স্মৃতিফলক। সেই সময় এই জায়গার নাম ছিল টাউন গার্ড রোড। এখনও খুঁজলে পুরানো দোকানের ঠিকানা সেই চিহ্নবহন করে।
ব্রিটিশ আমলে ঘড়ি মেরামত করত কুক অ্যান্ড কেলভি নামক একটি সংস্থা। ১৯৫৪ সাল থেকে কলকাতার বিবি দত্ত কোম্পানি ঘড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত। এরপর চুঁচুড়ার এন এস হোসেন অ্যান্ড কোম্পানি দায়িত্ব পায় ঘড়ির রক্ষণাবেক্ষণের। প্রতি চার বছর অন্তর ঘড়ির সার্বিক মেরামতি হয়৷ আনুমানিক খরচ ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। প্রতি চারদিন ছাড়া ছাড়া ঘড়িতে দমও দিতে হয়।
ঐতিহাসিক ঘড়ির সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে এক সময় মানুষের ভালোবাসায় এলাকার নামই বদলে যায়৷ হয়ে যায় ঘড়ির মোড়। একসময় এই ঘড়িকে ঘিরে চলাচল করতো ফিটন গাড়ি। বর্তমান সময়ে এই ঘড়িকে ঘিরে চলাচল করে বাস, অটো, টোটো, রিকশা ও মিনিবাস৷ রাস্তার মোড়ে ১৬ স্কোয়ার ফুট উচ্চতায় রয়েছে এই ঘড়ি। প্রতি আধঘন্টা অন্তর তার ঢং ঢং আওয়াজ শুনে আজও নিজের হাতের ঘড়ি মিলিয়ে নেন না এমন মানুষ মেলা ভার। ১৯৭৩ সালে ঘড়ির মোড়ের এই স্তম্ভটির উত্তর প্রান্তে স্বাধীনতা সংগ্রামী ভূপতি মজুমদারের আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
শতাধিক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী চুঁচুড়ার ঘড়ির মোড় আজকাল বেশকিছু রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দলের প্রচারের কেন্দ্রও হয়ে উঠেছে। ১০৬ বছর ধরে থাকা এই ঘড়িটি আজও জানান দেয় সঠিক সময়। জানান দেয় বাকি সমস্ত কিছু অতীত হয়ে গেলেও সে আজও বর্তমান, আজও প্রাসঙ্গিক সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। গত ১০৬ বছরে ঘড়ির কাঁটা মাত্র একবার থেমেছিল। ২০০৯ সালে প্রকৃতির তাণ্ডবলীলায় একদিনের জন্য থেমেছিল এই ঘড়ির কাঁটা।
প্রতিবেদন- নিজস্ব সংবাদদাতা
Post a Comment