ফিরে আসছে ফাউন্টেন পেন আর সুলেখা কালির যুগলবন্দী
সময়টা স্বদেশী আন্দোলনের। ১৯৩০ সাল, লবণ সত্যাগ্রহ। এই সময় মহাত্মা গান্ধী ইচ্ছা প্রকাশ করলেন দেশীয় কালিতে লিখবে ভারতবাসী। সেই ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে অবিভক্ত বাংলার রাজশাহীতে দুই বাঙালি ব্যবসায়ী ননীগোপাল মৈত্র এবং শঙ্করাচার্য মৈত্রের হাত ধরে পথ চলা শুরু করেছিল সুলেখা কালি। 'সুলেখা' এই নামটি দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
গান্ধী, ঠাকুর থেকে সত্যজিৎ রায় সকলের প্রিয় ছিল সুলেখার রয়্যাল ব্লু, একজিকিঊটিভ ব্ল্যাক এবং স্কারলেট রেড। তারা নিজেরা নিয়মিত এই কালি ব্যবহার করতেন। যদিও আজকের প্রজন্মের কাছে ফাউন্টেন পেন বা ঝরনা কলম খুব একটা পরিচিত নয়। সুলেখা কালির খবর তাদের কাছে স্বাভাবিক ভাবেই অজানা। এই প্রজন্ম ডট পেন বা জেল পেন ব্যবহার করতেই স্বচ্ছন্দ। যারা সুলেখা কালির কথা শুনেছেন তাদেরও অনেকেই সেটিকে হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ পাননি। তাদের কাছে সুলেখা কালি ইতিহাসের অঙ্গ। বাড়ির বড়দের নস্টালজিয়া। আসলে সুলেখা কালি শুধুমাত্র একটি পণ্য নয়, বাস্তবে ইতিহাস।
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে শুরু হয় স্বদেশী আন্দোলন। বিদেশী পণ্য বর্জন এবং স্থানীয় ভাবে তৈরি জিনিষ ব্যবহারের ডাক দেওয়া হয়। এই সময় বেশ কিছু নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয় যা আজকেও ভারত তথা বিশ্বের বাজারে নিজেদের সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখে ব্যবসা করে যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে আমাদের প্রায় সকলের পরিচিত এশিয়ান পেন্টস, প্রসাধনী জগতের অন্যতম নক্ষত্র ল্যাকমি, টাটা ষ্টীল প্রভৃতি।
সেই সময় নতুন পণ্য তৈরিতে বাংলা ছিল প্রথম সারিতে। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই তৈরি হয়েছিল সুলেখা কালি। আগেই বলা হয়েছে মহাত্মা গান্ধী নিজে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন দেশীয় লেখার কালি তৈরির। তিনি তাঁর এই ইচ্ছার কথা বলেন বাংলার বিপ্লবী সতীশ চন্দ্র দাশগুপ্তকে। সতীশ চন্দ্র দাশগুপ্ত ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী। তিনি তার নিজের হাতে তৈরি করেন 'কৃষ্ণধারা' কালি। কৃষ্ণধারা কালি ভারতে তৈরি প্রথম লেখার কালি।
এরপর সতীশ চন্দ্র দাশগুপ্ত অবিভক্ত বাংলার রাজশাহী অঞ্চলের দুই ভাই ননীগোপাল মৈত্র এবং শঙ্করাচার্য মৈত্রের সঙ্গে কালি তৈরি শুরু করেন। এই দুই ভাইয়ের পিতা অম্বিকাচরণ মৈত্র এবং মা সত্যবতী দেবী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। শুরু হয় সুলেখা কালির পথচলা।মানুষের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় এই কালি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
একটু লেখা নিয়ে চর্চা করা যাক। লেখা জিনিষটি বেশ রহস্যজনক। মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য বহু হাজার বছর আগে লেখার সাহায্য নিয়েছিল। কিন্তু কেন? প্রথম কিসের প্রয়োজনে লেখার অভ্যাস শুরু হয়? মুখের ভাষায় যা প্রকাশ করা যাচ্ছে না সেটা প্রকাশ করতে, নাকি মনের ভাব প্রকাশটিকে কিছুটা স্থায়ী চেহারা দিতে? হয়তো বা পথ চেনার জন্য সংকেত তৈরি করতে করতে অথবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কিছু জানিয়ে যাওয়ার ইচ্ছার তাগিদেই লেখার শুরু হয়েছিল। হয়তো কোনো একটি নয় অনেক কারণ থাকতে পারে।
যতদূর জানা যায় সুমেরু সভ্যতায় লেখার উৎপত্তি। যা দক্ষিণ মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের একটি সভ্যতা। ৩২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে এই সভ্যতায় লেখার উৎপত্তি বলে জানা যায়। কেউ কেউ আবার বলেন এই সময়েই প্রাচীন মিশরেও লেখার পদ্ধতি আবিষ্কার হয়।
স্থান কাল যাই হোক না কেন লেখার সঙ্গে কালির কমবেশি যোগাযোগ ছিল প্রথম থেকেই। দিন যত এগোতে থাকে লেখার মাধ্যম হিসেবে কালি, কলম ততোই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মনে করা হয় প্রথমে আঙ্গুলে কালি লাগিয়ে লেখার কাজ করা হতো। পরবর্তী সময় কাঠের টুকরো ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। তার পরবর্তী সময় আসে পাখির পালকের ব্যবহার।
এরপর শুরু হয় ফাউন্টেন পেন আর কালির যুগলবন্দী।মিশরের সম্রাট মা'দ আল-মুয়িজ প্রথম কলম তৈরির বিষয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। ফিরে আসি সুলেখা কালির কথায়। ব্যবসা বাড়তে থাকায় ননীগোপাল মিত্র তার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার চাকরিটি ছেড়ে দেন। রাজশাহী থেকে কলকাতায় চলে আসে প্রতিষ্ঠান। কলকাতায় আসার পর সুলেখা কালি 'প্রফেসর মিত্রের কালি' বলে ব্যাপক ভাবে পরিচিতি লাভ করে। যারা সুলেখা কালির সঙ্গে পরিচিত, নিয়মিত কিনতেন তারা জানেন মূলত তিন ধরণের কালি বাজারে প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হতো। রয়্যাল ব্লু, একজিকিঊটিভ ব্লাক এবং স্কারলেট রেড। প্যাকেটে ইংরেজি, বাংলা সহ মোট ১৪ টি ভাষায় কালির নাম লেখা থাকতো।
সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম পছন্দ ছিল সুলেখা কালি। ১৯৭৬ সালে তৈরি হওয়া জনারণ্যে চলচ্চিত্রের প্রথম দৃশ্যেই তিনি সুলেখা কালিকে সময়ের একটি স্মারক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও সমাদ্দারের চাবি গল্পে আমরা তার ফেলুদার ভাষ্যে সুলেখা কালির ব্যবহারের উল্লেখ দেখতে পাই।
প্রথমে বউবাজারের একটি ঘরে পরবর্তী সময়ে কসবা হয়ে অবশেষে যাদবপুরে নিজেদের কারখানা তৈরি করে সুলেখা ওয়ার্কস লিমিটেড। যারা ভাবেন বাংলায় এখন যেমন শুধু বহিরাগতদের বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক হিসেবে দেখা যায় আগেও তেমনই ছিল। বিষয়টি কিন্তু একেবারেই তা নয়। সুলেখা কালির ইতিহাস দেখলে সেটাই প্রমাণ করে। যাদবপুরের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর চব্বিশ পরগনার সোদপুরে এবং পরবর্তী কালে গাজিয়াবাদ, দিল্লী, মাদ্রাজ, মুম্বাই পর্যন্ত অফিস তৈরি করে সুলেখা কালি। শুধু তাই নয় ইউনাইটেড নেশন সুলেখা ওয়ার্কস লিমিটেডকে সাউথ আফ্রিকায় একটি কারখানা গড়ার ডাক দেয়।
সময়ের হাত ধরে এরপর জনপ্রিয় হতে থাকে বল পেন।কমতে থাকে কালির ব্যবহার। অবশেষে ১৯৮৯ সালে সুলেখা কালি তাদের কালি তৈরি একেবারে কমিয়ে দেয়। কিন্তু থেমে যাওয়া মানেই শেষ হয়ে যাওয়া নয়। অন্তত যখন সেটা এক বাঙালির কাহিনী। সেখানে বারবার ঘুরে ফিরে আসে, ঘুরে দাঁড়াবার গল্প। বল পেনের দুর্নিবার বাজারে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করে সুলেখা কালি। ২০০৬ সালে আবার ফিরে আসে স্বমহিমায়। একের পর এক নতুন কালি বাজারে আসতে থাকে। ননীগোপাল মৈত্রের নাতি কৌশিক মৈত্রের হাত ধরে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে ডালপালা মেলতে থাকে ব্যবসা।
কেন ফাউন্টেন পেন অনেক ভালো বল পেনের থেকে। কৌশিক বাবু একটি হিসেব দিয়ে দেখিয়েছেন ফেলে দেওয়া বল পেন থেকে যে পরিমাণ প্লাস্টিক দূষণ হয় সেটা কল্পনাতীত। শুধু তাই নয়, হাতের লেখা থেকে মনসংযোগ সব কিছুই ভালো হয় ফাউন্টেন পেন বা ঝর্না কলমে। উৎসাহের কথা কালির ব্যবহার আবারও বাড়ছে। শুধু পুরানো প্রজন্মই নয় নতুন প্রজন্ম এই ব্যবহারকে আরও গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই আশা করাই যায় আগামী দিনে আবার বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিক ভাবে যুক্ত সুলেখা কালি বাংলা তথা ভারতের প্রতিটি ছাত্রের পড়ার টেবিলে, প্রতিটি দপ্তরে, প্রতিটা পাঠ কক্ষের আবশ্যিক অঙ্গ হয়ে উঠবে। সময়ের হাত ধরে ফিরে আসে ইতিহাস, বর্তমানের জমিতে। বট বৃক্ষের মতো শিকড় ছড়ায় চেতনায়। যা কিছু একান্ত এই মাটির, যা কিছু সৃজন হয়েছে ভূমিপুত্রদের রক্ত, ঘামের বিনিময়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখে দেশজ প্রস্তর কঠিন হাত আর জাতিসত্তার চেতনায় লালিত গর্বিত উঁচু করা মাথা। সেই সম্পদ প্রবাহিত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, পূর্বসূরি থেকে উত্তরসূরির জীবনে। এটারই নির্দশন আজকের সুলেখা কালির চমক জাগিয়ে ফিরে আসা।
প্রতিবেদন- অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়
Post a Comment