ব্রিটিশ আমলে একগুচ্ছ আবিষ্কার করে ভারতে শিল্প বিপ্লব ঘটান বঙ্গসন্তান জগদীশ্বর ঘটক
ব্যবসা বাণিজ্যে নাকি বাঙালির আগ্রহ নেই। বাঙালিরা নাকি উদ্যোগপতি হতে ভয় পায়। এই মিথ্যা মিথের ওপর দাঁড়িয়ে বাঙালি সমাজ। অথচ বাঙালির ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই ব্যবসা বাণিজ্যেও বাঙালি মোটেই পিছিয়ে নেই। আমরা ভুলে গেছি বহু বাঙালি উদ্যোগপতিদের কথা। একসময় রীতিমতো রিস্ক বা ঝুঁকি নিয়ে বাংলার বুকে অসংখ্য কারখানা গড়ে তুলেছিল বাঙালিরা। সেইসব কারখানার যন্ত্রপাতিও তৈরি করেছিলেন বাঙালিরাই। যাকে চিরাচরিত ভাষায় 'ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প' বলা হয়৷ যে শিল্পেও যুগের পর যুগ বাঙালিরা নিজেদের বুদ্ধিমত্তাকে কাজ লাগিয়েছে। এখনও সেই ধারা চরৈবতি।
ভারতের প্রথম ভারীশিল্পের প্রতিষ্ঠাতাই তো ছিলেন একজন বাঙালি। বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় হলেন ভারতের প্রথম ভারীশিল্পের প্রতিষ্ঠাতা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আলামোহন দাশ, রাজেন মুখার্জির মতো বহু শিল্পপতি উজ্জ্বল করেছে বাংলার মুখ৷ ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে বাঙালিরাই মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল দেশীয় শিল্পের। বাঙালিদের হাত ধরেই এসেছিল দেশের শিল্প বিপ্লব। যাকে অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। ১৮৮৫ সালের কথা, জগদীশ্বর ঘটক নামের এক বঙ্গসন্তান সূচনা করেন একটি যুগান্তকারী শিল্পের।
বাঙালিদের খাদ্যের প্রধান উৎস হলো ভাত। প্রাচীন সময় থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে ঢেঁকিতে ধান পিষে চাল বের করা হতো। তবে এটাতে দীর্ঘ সময় লাগে। প্রচুর পরিমাণে এতে দৈহিক পরিশ্রমও করতে হয়। ইউরোপে যেহেতু ধান ভাঙার কোনো যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি, তাই এদেশে প্রচুর ধান চাষ হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশরা ধান ভাঙার জন্য কোনো যন্ত্রের কথা ভাবেনি। অতএব ধান ভাঙার জন্য আধুনিক যন্ত্র আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে দেখা দিলো। যে প্রয়োজন অনায়াসে মেটালেন বঙ্গসন্তান জগদীশ্বর ঘটক।
বাঙালিরা জগদীশ্বর ঘটক নামটির সঙ্গে সেভাবে পরিচিত নয়। ইনি হলেন একজন যন্ত্রকারিগর ও নামকরা উদ্যোগপতি। ভারীশিল্পে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। ১৮৯৬ সালে জগদীশ্বর ঘটক ধান ভাঙার যন্ত্র 'রাইস হাস্কিং মেশিন' উদ্ভাবন করেন৷ যা নিয়ে সেকেলের স্ট্যাটসম্যান পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে খবর ছাপা হয়েছিল। কেবল 'রাইস হাস্কিং মেশিন' আবিষ্কার করেই থেমে থাকেনি তাঁর যাত্রা। ১৮৮৫ সালে তিন চাকার এক জলজ সাইকেল উদ্ভাবন করেন তিনি। অভিজাত সম্প্রদায়ের বাঙালির কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই সাইকেলটি। জ্যোতির্ময় ঠাকুর, শাজাহানপুরের রাজা ও বর্ধমানের মহারাজা কিনেছিলেন এই সাইকেল। জগদীশ্বর ঘটক এ আবিষ্কারটির জন্য পেটেন্ট পাননি। জীবনের প্রথম আবিষ্কারের স্বাদে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন ব্যবসায়ীক লাভ বা লোকসানের কথা৷ 'রাইস হাস্কিং' মেশিনের সাথে ১৮৯৬ সালে তিনি 'পাংখা-পুলিং' নামের আরেকটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। এ যন্ত্রটির জন্য তিনি প্রথম পেটেন্টের আবেদনও করেছিলেন।
১৮৯৮ সালে তিনি 'বয়েলড রাইস কুকিং অ্যাপারেটাস' নামে আরেকটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্র আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পেন্টেন্ট পেয়ে যান। ঐ বছর শিল্প-বাণিজ্যের এক প্রদর্শনীতে তিনি 'রাইস হাস্কিং' মেশিনের জন্য স্বর্ণপদক অর্জন করেন। ১৯০২ সালে তিনি 'প্যাডি হাস্কিং অ্যান্ড ক্লিনিং মিল' এবং ১৯০৪ সালে 'মেশিনারি ফর ট্রিটিং প্যাডি উইথ স্টিম' ও 'হট অ্যান্ড কোল্ড এয়ার' নামক কতগুলো যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তাঁর এই তিনটি আবিষ্কারও পেন্টেন্ট লাভ করে। হরেক রকমের যন্ত্র আবিষ্কারে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর আবিষ্কারগুলি গৃহস্থের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিল।
জগদীশ্বর ঘটকের আবিষ্কৃত 'রাইস হাস্কিং' মেশিনের হাত ধরে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল মূলত রাঢ় অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য রাইস মিল। যে রাইস মিলগুলির বেশিরভাগ মালিকই ছিলেন বাঙালি। বাংলার গ্রামাঞ্চলের প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে যায় তাঁর হাত ধরেই। তিনি তাঁর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে পাল্টে দেন বাংলার গ্রামাঞ্চলের চিত্র৷ একগুচ্ছ যন্ত্র আবিষ্কারের পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নিজস্ব আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলির অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা। ধীরে ধীরে তিনি তাঁর সকল আবিষ্কারের জন্য পেটেন্ট লাভ করেন। যার হাত ধরে বাংলার গ্রাম্য অর্থনীতিতে পরিবর্তনের ঝড় বয়ে গিয়েছিল, সেই তিনিই বাংলার ইতিহাসের আড়ালেই থেকে গেলেন। জগদীশ্বর ঘটকের মতো একজন জগদ্বিখ্যাত বাঙালি যন্ত্র কারিগর ও উদ্যোগপতির কথা বাঙালি একেবারেই ভুলে যায়।
তথ্যসূত্র- সিলিপয়েন্ট, কলের শহর কলকাতা (সিদ্ধার্থ ঘোষ)।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment