চরঘেরীতে বাঘের ডেরা থেকে উমাশঙ্কর || দ্বিতীয় পর্ব
বসন্ত মোড়ল থাকত গারাল নদীর পাশে চরঘেরীর ভেড়ির পাশে। সারা জীবন মাছ কাঁকড়া মেরে তার জীবন চলে গেল। আবার সেই বসন্ত মোড়লে এর ছাওয়াল সুবল জল জঙ্গল কে জীবিকা হিসেবে বেছে নিল। সুবল জঙ্গল টাকে একদম নিজের হাতের তালুর মতো চিনত। সুন্দরবনেই সুবলের প্রাণ গেলো। সেই জঙ্গলের ঘরে বাঘের কাছে ছেলে প্রথম দিকে কেমন জঙ্গলের প্রতি আকর্ষণ না থাকলেও বিয়ে করার পর জঙ্গলের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়।
সুবলের বাচা ছাওয়াল বাবলু'র ছোটবেলা থেকে একটু জঙ্গল -টঙ্গল এর টান ছিল কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের পথে চরম নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আসলে ব্যাপারটা নেশাগ্রস্ত হওয়ার কারণ পেটের তাগিদ সংসার চালানোর প্রয়োজনীয়তা সব দিকে না করলে এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিয়ের পর বাবলু সন্তর হয়েছে আলাদা খায়। বাবার জমির একমাথায় এক ছোট ঘর করে থাকে।
বর্ষাকাল চারদিকে তখন মাছ ধরার মরশুম চলছে। তবে মাছ ধরার থেকে কাঁকড়া মারার উপরেই লোকের বেশি নজর, দামও বেশি পাওয়া যায়। অল্প সময়ে বেশি উপার্জন করা যায়। সেই লোভটাও সামলাতে পারেনি বাবলু।
খালে গোড়ার মনো আর ভাইরা ভাই অতীন আর বাবলু জঙ্গলে বেরিয়ে পড়েছিল।
ছয় সাত দিনের শিকদারের দোকানের বাকিতে চালান এ যাওয়ার মালপত্র তুলে নেয়।
মনো ও অতীন ভাইরা। বিল ও কম হয় নি সেবার ২৭০০ টাকা। ঘাটে এসে মাল বিক্রি করে টাকা দিতে হবে।
অতিন ভাইরা নৌকোর সব জিনিসপত্র গুছিয়ে গাছিয়ে বাবলু সেদিন কি বেরিয়ে পড়েছিল কাঁকড়া ধরতে।
নৌকোর পারমিট, রেজিস্ট্রি সব বাবলুর এটা পূর্বপুরুষের পাওয়া। ভন্যা গণে বাবলুদের নৌকা তরতর তরতর করে এগিয়ে চলেছ চলেছে। বামনি, তারার খাল, পালা, তেরো বাকি। প্রথম দিন ভড়ের খালে কাঁকড়া ধরে। মাল সে রকম না হলেও মোটামুটি হয়েছে। এই ভেবে বাবলুরা ওই খালেই থেকে যায়। পরের দিন জোয়ারের কাঁকড়া ধরার জন্য সন্ধ্যাবেলা গল্প-টল্প করে রান্না করে ঘুমিয়ে পড়ে। পরের দিন সকাল সকাল শেষ ভাটায় নৌকো সব রেডি করে নেয় আস্তে আস্তে গণের জল বাড়তে থাকে। কাঁকড়া ধরা শুরু হয়ে যায়।
ভাটার জল আবার নামতে শুরু করে বিশাল বড় চর। খালের মাঝখানে প্রায় ১০০ফুট মতো জল, দুই পাশে প্রায় ১০০ ফুটের মতো চর। তারপর ১০০ ফুটের মতো শক্ত সবটা চরে অল্প গাছ বসেছে।
দুপুর আড়াইটার দিকে, হঠাৎ বাবলু বলে ওঠে অতিন, দুপুরবেলা কি খাবি। একটু মাছ মারলে হত। দু খ্যামন দিলে হয়ে যাবেকন। মাছ লেগেছে খুব জলে। নৌকা থেকে জাল ফেলল মাছ হলো না। তারপর বাবলু নৌকা থেকে নেমে খালের মুখে জাল দিতে নেমে যায়। এক পাড়ে জাল বাধা হয়েছে আর এক পাড়ে জাল বেঁধে নৌকোয় আসবে। সেই সময় বাঘ আচমকা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ছুটে এসে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে বাবলুর গায়ে।
বাবলু তৎক্ষণাৎ ডুব সাঁতার দিয়ে ভাটিয়ে যায়। বাঘ ওই জায়গায় হ্যাতো দিয়ে বাবলুকে খুঁজতে থাকে আর বিকট আওয়াজ করতে থাকে। এদিকে নৌকোয় অতিন, মনো বড় গরানের কড়া নিয়ে জলে বাড়ি মারতে থাকে আর দাওড় দিতে থাকে কিন্তু এ বাঘ ভয় পায় না। ডেঞ্জারাস বাবলুর মাথা উঁচু করে দেখে যে বাঘ একই জায়গায় জলের মধ্যে হাতড়াচ্ছে।
হঠাৎ করে আবার জঙ্গলে উঠে যায়। পাড়ের ছোট একটা গাছের গায়ে পুরো বডিটা লম্বা করে লাগিয়ে দ্যায় আর মাথাটা বার করে হালুক-ফালুক দেখতে থাকে। আমরা সব দেখতে পাচ্ছি কিন্তু কিছু করা যাচ্ছে না আবার এদিকে ভাটা একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। যা করার কুড়ি পঁচিশ মিনিট এর মধ্যে করে ফেলতে হবে মরণ বাচন এর লড়াই।
আমি মাথা উঁচু করে দেখি নৌকো ক্যতদূর, তাও ৩০ ফুট কত হবে। আমি মনে মনে ভাবি যা হয় হবে এই ডুব সাঁতার দিয়ে নৌকায় উঠতেই হবে। ওদের পাশে না গেলে ওই বাঘ আবার ছুটে আসবে এই বলতে না বলতেই বাঘ জাম্প দিয়ে পড়ে বাঁ দিকে। মনো অতিনরা জলে শুধু গরানের কড়া দিয়ে বাড়ি মারতে থাকে আর আমি ডুব সাঁতার দিয়ে নৌকার ডান দিকে গিয়ে উঠি। বাঁদিকে বাঘ আর ডান দিকে আমি।
কি বলবো দাদা জলের তলায় কুড়ি মিনিট মতো ছিলাম। মনে হচ্ছে আমি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি আর জলের তলায় সব দেখতে পাচ্ছি। নৌকার ধারে যেতেই মনো তাড়াতাড়ি করে নৌকায় তুলে। আমায় ডরাই ঢুকিয়ে দেয়, বাঘ এদিকে নৌকার কানায় হ্যাতো লাগিয়ে বাবলু কে খুঁজতে থাকে। তাকিয়ে থাকে ডরার দিকে। চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে। জিভ দিয়ে লালা ঝরছে। শরীর-টরীর ক্যামন যেন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো।
বাবলুর মুখ থেকে যখন শুনছিলাম। ওর শরীরের লোমগুলো পুরো খাড়া হয়ে গেছিল, চোখে মুখে ছিল সাহসিকতার নিদর্শন কিন্তু পেটের জন্যই এই লড়াই দীর্ঘদিন দুপুরে বা রাতে ঘুমালে খালি বলতে থাকে। এই বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে ঘরের পেছনে কলা গাছের পাতা যদি ঘরের চালে হাওয়ায় দুলতে থাকে আর আওয়াজ হয় ঘুম থেকে ধরফর করে উঠে। বাবলু বলতে থাকে ঘরের চালে মনে হয় বাঘ উঠেছে।
বাবলুর এখনো দুটো সংসার একটা বাড়ি আর একটা সেই জঙ্গল সাম্প্রতিক দৈনন্দিন কাউকে বাবলু, সুরঞ্জন মন্ডল ও তাপস মন্ডল এই তিনজন দৈনন্দিন কাঁকড়া মারতে যায়। বাড়ির ঠিক অপর পাড়ে ঝিলা কম্পার্টমেন্ট টু তে। বড়খাল, পশুরখাল, হেতাঁল বুনে খাল, বানতলা। খালে নৌকায় বসে থোঁপা দিয়ে কাঁকড়া ধরে।
-কি করব বল, দাদা যা হয় সংসার চলে কিন্তু রিক্স থাকে হান্ডেট পার্সেন্ট। দেশে তো তেমন আয় নেই। তাই সবাই জঙ্গলে যায়। ভোটা আসে ভোট যায়। এখানকার মানুষের কোন আয়ের এর পরিবর্তন হয় না।
প্রতিবেদন- উমাশঙ্কর মন্ডল
Post a Comment