Header Ads

চরঘেরীতে বাঘের ডেরা থেকে উমাশঙ্কর || প্রথম পর্ব


বামাচরণ এর ছেলে হরেন।  এই নামে সবাই চেনে। জঙ্গল জীবনে তার সামনে থেকে মানুষকে তুলে নিয়ে গেছে বাঘ, আবার বাঘকে মেরে সঙ্গীকে ফিরিয়ে এনেছে। তার  জল জঙ্গল জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা শুনলাম। আসুন দেখে নেই সেই মর্মান্তিক ঘটনা গুলি কেমন ভাবে হয়েছিল।

প্রথম গল্প:- আমার তখন বছর-দশেকের বয়স গরুর রাখালী করতাম, মাটির কাজ করতাম। একদিন দাদারা বলল, কাজ করতে হবে না। জঙ্গলে চল, এই বলে দাদার সঙ্গে জঙ্গলে গেলাম। প্রথম নদী, নালা, চেনা ভালোই লাগছে।


সে বার তেরো বাকির তারার খালে গেছিলাম। সঙ্গে মায়দা দেবেন মন্ডল, তারাপদ, উপেন মন্ডল।

-সে বার বার কান মাছ মারতে গিয়েছিলাম। কান মাছ মারতে গেলে জঙ্গলের ভিতরে দৌড়ে দৌড়ে হয় দনের জন্য  চারা জোগাড় করতে হয়। এবার ভাড় নিয়ে গেছো কাকঁড়া ধরছি হাত দিয়ে।

আর এদিকে বড় ভাই উপেন চেল্লাচ্ছে আর চারা লাগবে না।

- ও বেলার জন্য হয়ে যাবেখন। ও কোন কথা শুনছে না কিছুতেই। 

-ও বেলার জন্য কিছু ধরে নেই বলে গেছো কাঁকড়া ধরতে লেগেছে। 

এমন সময় বাঘ লাফ দিয়ে পড়ে দেবেনের ঘাড়ে। দেবেন ও মরূ ছিল লম্বা-চওড়া হাতে পদে বেশ শক্তিশালী। খালের ভিতরে ফেলেছে কাদা জলের মধ্যে, বেহুঁশ অবস্থায় ভাড় দিয়ে বাঘের মুখে বারোবাড়ি করছি। তার আপাতত ছুটেছে নৌকার দিকে হাত দিচ্ছি। 

এদিকে আয় আমার ভাইকে বাঘে নিয়ে যাচ্ছে।

তুই ওই দিকে যাচ্ছিস তারা আবার খাল ধারে দিয়ে হেটে যাচ্ছে লাঠি নিয়ে, উপেন ভাই দেবেনকে টেনে নিয়ে আনছে রক্তে ভেসে যাচ্ছে একবারে।

নৌকো তোলার সাথে সাথে ওই বাঘ আবার  ঝাঁপিয়ে পড়েছে নৌকার পাশে। চারিদিকে কাদাজল তোলপাড় করে দিচ্ছে। শুধু হুংকার দিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলে যেন মনে হচ্ছে ভূমিকম্প হচ্ছে। তারপর নৌকা ছেড়ে চলে আসি। সে যাত্রায় বেঁচে যাই। 

দ্বিতীয় গল্প:- তখন দুই দেশেই গোলপাতার ঘর ছাওয়ার খুব চল ছিল। আর আগে বনে গোলগাছ পাওয়ায় যেত।সরকার থেকে পাশ দিত। সেবার আমার দাদা খগেন গোলপাতা কাটতে গেছিলো।

চাঁদখালী ঘেরে। ওই ঘেরে নাকি গোলপাতা বেশি পাওয়া যেত। তাছাড়া সরকার থেকে নির্দিষ্ট এলাকাও করে দিত। সেবার গোলাম, কাশেম, মাজেস, কেনা সরদার  ওদের সাথে গিয়েছিল। পাতা  কাটার সময় ছয় মাসের। এর মধ্যে পাতা কাটতে হবে।  সেদিন দাদা সকাল বেলা পান্তাটান্তা খেয়ে পাতা কাটতে নামে। মাল কেরকম যেন ভারভার ঠেকছে। এই বলতে বলতেই বাঘ গোলগাছের আড়াল দিয়ে লাফ দিয়ে পড়ে। সাথে সাথে মুখে করে নিয়ে চলে যায়। ঘন আটোবন, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। খোঁজ খবর পাওয়া যায় নি।

তৃতীয় গল্প:- এদিকে সংসারের খুব টানাটানি। দিন আনা দিন খাওয়া। সে রকম কাজকর্ম নেই সরের পাড়ে। দাদার কাজকর্ম করে৷ ১৪-১৫ দিন পর নগেনদাদা আবার গোলপাতা কাটতে  যায়।বাড়ীর সবাই বারন করে ছিল। কিন্তু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে জঙ্গলে যায়। তেমন টাকা-পয়সা দিত না। ৩০ টাকা মাসে দিত আর ভালো মাঝি হলে ৫০ টাকা দিত।১৪-১৫ মনের কিস্তির নৌকো। ভরতি করতে সময় লাগত অনেক। বসিরহাটের নারায়ন বাবুর নৌকা ছিল দাদা। শুনতাম ঔ মাল নাকি অনেক টাকায় বিক্রি হতো। 

সেদিন সকাল বেলা মাল কেটে এক জায়গায় ঝাঁপ  দিয়ে রেখেছে। দুপুরবেলা খাওয়ার পর মাল নৌকায় তুলবে। মাল সবেমাত্র ঘাড়ে তুলেছে। ওমনি বাঘ লাফ দিয়ে পড়ে। চারিদিকে লোক কিন্তু, তার মধ্যেই চোখের নিমেষে আড়াল হয়ে যায়। 

এসব বলতে চোখে জল এসে যায় নিজের দুটো ভাই একমাসের এদিক ওদিকের মধ্যে বাঘে ধরে। তাও জঙ্গল করি। কি করবো। সরের পাড়ে তো কাজকর্ম নেই। 

চতুর্থ গল্প:- সেবার আমি অশোক মিস্ত্রি, সুবল আর আমার গুরুমশাই ভূপেন, খোকন ছিল। 

চোরাই গাজী গেছিলাম। চর বেরিয়ে গেছে। অশোক আর খোকন নৌকায় ঘুমিয়ে আছে। আমরাও আছি।

- পাগল ওট, বৈশাখ মাস গরমে ঘুমাচ্ছিস কি করে কে যানে।

-হেঁতালের কাটা গুলো একটু বার করে দে, সবে তিনটে কাটা বার করেছি। সেপটিপিন তা ভোঁতা।কাটাবার জো নাই। গন্ডারের চামড়ার মতো পার তলার চামড়া শক্ত হয়ে গেছে।

আমাগো খাবার মাছ নেই, তাহলে কটা মাছ ধরে নেয়, এই বলে নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নেমে যায়। খাদের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কপচাচ্ছে। আমরাও লক্ষ্য রেখেছি জঙ্গলের দিকে। এর মধ্যে আট-দশ ফুট ওপর থেকে বাঘ লাফ দিয়ে পড়ে অশোকের ঘাড়ে। আমরা সবাই হাকার দিচ্ছি, বাঘ শুনছে না কিন্তু। কুড়ুল নিয়ে যেতে যেতে তিন লাফে নিয়ে চলে যায়। 

বেলা বসে যায়। ছোট চামটার খালে আসতে আসতে অন্ধকার নেমে আসে। গুরুমশাই আমরা খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গা শূলোরগায় আন্ডার প্যান্ট পেলাম। আর একটু এগিয়ে গিয়ে ঘুনসি পেলাম। লাশ না পেয়ে ফিরে এলাম। চরঘেরীর সমিতির ঘাটের ধারে এসে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট ধরে ফেলে। নৌকো, মধু সব নিয়ে নেয়। অনেক হাটাহাটি করে মাস পাঁচেক বাদে নৌকা ফেরত পাই। ফরেস্ট অফিসার কে ধরমবাবা বলে।

পঞ্চম গল্প:-  কাকঁড়ার পাশে গেছিলাম। দিবাকর, হরেন, স্বপন গিয়েছে। তারার খালের আড় পাড়ে।

মায়ের ঘরে পারে এপারে আর আমরা ও পারে। খাওয়ার জন্য মাছের দু খ্যামন ফেলেছি।

শব্দ হলো কি, একটা শব্দ হলো পাঁচ সাত দূরে হাত দূরে। শুকনো ডালের আওয়াজ, কিন্তু মচমচ করচে যে, -হরেনদা আওয়াজটা ভালো ঠেকছে না যে। স্বপন জঙ্গলে এলে ভয় করলে হবে। মা আছে পাশে মার নাম স্মরণ কর। 

আবার মার ঘরের সামনে নৌকা চাপিয়েছে। মাছ-টাছ কুটে-কাটে। রান্না চাপিয়েছে। খাওয়া দাওয়া সেরে রাতে মায়ের ঘরে সামনে নৌকা চাপিয়ে ঘুমালাম। 

সকালবেলায় পান্তা খাওয়ার বেলায় জোয়ার আসছে অনেক দেরি আছে। বেলা নটা দশটা বাজে রান্না চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। দন ফেলতে তারপর যাবো। 

-খালের মুখে  আছাল হেঁতাল গাছ। 

একটা ব্যাকোড় আছে। নৌকা ঢোকার সাথে সাথে ডুলোটা ফেললো।
 
ফেলার সাথে সাথে স্বপন বলছে -দাদা গো বাঘ।

বাঘ লাফ দিয়ে স্বপনের ঘাড়ে পড়ে। জলে ফেলে দেয়। দুই ফিট মতো জল, এই চার ফুট গরানের লাঠি দিয়ে নৌকার গায় বাড়োবাড়ি করতে করতে ছেড়ে দেয়।

তারপর ওকে নৌকায় তুলে  নিয়ে আসি। থুতনি, পাওড়ো কামড়ে দিয়েছে। রক্তে ভিজে  যাচ্ছে। কামড়ের জায়গায় চিনি দিয়ে গামছা বেঁধে দেওয়া হল। তড়িঘড়ি করে দত্ত অফিসের  ছোট ও বড় বাবু আমাদের নিয়ে চলে গেল।

স্বপনেরে যে করে বাঁচিয়েছি তা আমিই জানি।

আমি প্রথমে একবার জঙ্গলে গিয়ে বুঝতে পারি কিছু মন্ত্র তন্ত্র শিখতে হবে, না হলে জঙ্গলের কাজ করা যাবে না। তখন বাংলাদেশের কয়রাত  চলে যাই। সেখানে পাঁচ  বছর মন্ত্র তন্ত্র শিখে আসি।

পোড়োর  সামনে বার কয়েক পড়েছিলো।

- এই সেদিন খালেকদা গায়ে বসা আমাগো নৌকা আগার দিক থেকে জল আসছে। এদিকে রাত তখন এগারোটা বারোটা। একজন আমাকে বলছে -হরেনদা গাছের গায় কাছি বাঁধতে হবে। জল ঠেলছে খুব জঙ্গলের ভেতর থেকে আবার কথা বলছে হিসহিস করছে, মন্ত্র বলছে আমি তো ব্যাপারটা বুঝে গেছি তাড়াতাড়ি উঠে। কাঠ পুড়িয়ে মন্ত্র দিয়ে জঙ্গলের দিকে জলন্ত কাঠ ছুঁড়ে মারি। তখন জঙ্গলের ভেতর থেকে বলছে গুরুমশাই চলে যাচ্ছি। 

প্রতিবেদন- উমাশঙ্কর মন্ডল

No comments