কলকাতার ঐতিহ্যময় ট্রামের একাল-সেকাল
প্রতিটি শহরেরই কিছু নিজস্বতা থাকে। যা দিয়ে সেই শহরকে চেনা যায়। সময় বদলায়, সময়ের সঙ্গে বদলায় শহরের চেহারা। বদলে যায় বাড়িঘর, বদলে যায় বাজার-দোকান, কিন্তু শহরের নিজস্বতা থেকে যায় বনস্পতির শিকড়ের মতো। যতই তার ডালপালা কাটা হোক বা ছিন্নমূল করে দেওয়া হোক, বনস্পতির শিকড় থেকে যায় মাটির অন্তরে যুগ যুগান্ত ধরে। কলকাতার ট্রাম এই শহরের তেমনই এক উত্তরলব্ধি। যা কলকাতার মাটির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।
যা কিছু প্রথম এবং একমাত্র তা একটু বেশি আপন। তাই শুধু নয়, তার অনুপস্থিতিতে জেগে ওঠে অতীত-আর্তি, ইংরেজিতে যাকে বলে Nastalgia। কলকাতার ট্রাম ভারতে প্রথম এবং বর্তমানে একমাত্র পরিষেবা প্রদানকারী ট্রাম। ইতিহাসের দিকে নজর ফেরালে ১৮৭৩ সালে কলকাতায় প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রামের কথা জানা যায়। দিনটি ছিল ২৪ ফেব্রুয়ারি। জানা যায়, স্বল্প ব্যয়ে যাতায়াতের জন্য মানুষের সুবিধার্থে লর্ড কার্জন ট্রাম চালু করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
প্রথম ট্রামের যাত্রাপথ ছিল আর্মেনিয়া ঘাট থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত। বলে রাখা ভালো এটাই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ট্রাম পরিষেবা। আড়াই মাইলের কিছুটা কম যাত্রাপথ ধরে এই ট্রাম চলাচল শুরু করে। এই ট্রাম ছিল ঘোড়ায় টানা। ঘোড়াটি বাঁধা থাকতো ট্রামের সামনে। কাঠের তৈরি এই ট্রামের চালক সামনের কেবিনে দাঁড়িয়ে ঘোড়াটিকে পরিচালনা করতেন। লাইনের উপর দিয়ে ট্রাম এগিয়ে যেতো গন্তব্যের দিকে।
ট্রাম কোম্পানির ইতিহাস বলছে, অস্ট্রেলিয়ান ওয়েলার ঘোড়ার সাহায্যে প্রথম ট্রামটি চলেছিল কলকাতায়। সেই ট্রামের সামনে ঝোলানো থাকতো একটি পিতলের ঘণ্টা। যেটিকে বাজিয়ে পথ চলতি মানুষকে ট্রামের যাত্রাপথ খালি করার জন্য সতর্ক করা হতো।
কলকাতায় প্রথম ট্রাম চালু হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে সেটি বেশিদিন চলেনি। যাত্রী কম হওয়ায় কিছুদিন বাদে ট্রাম পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। জানা যায়, ১৮৭৩ সালেরই ২০ শে নভেম্বর ট্রাম চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এরপর "লন্ডন ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি" নামে একটি লন্ডন ভিত্তিক কোম্পানি কলকাতায় ট্রাম পরিষেবা শুরু করে। ১৮৭৯ সালে লন্ডন ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি ও কর্পোরেশনের মধ্যে হওয়া চুক্তি মোতাবেক, পুনরায় ১৮৮০-র ২৭ শে নভেম্বর কলকাতার রাজপথে অশ্ব চালিত ট্রামের আবার চলাচল শুরু হয়।
এই কোম্পানিটির কাছে সেই সময় ট্রাম পরিষেবার জন্য ছিল এক হাজার ঘোড়া। এই এক হাজার ঘোড়া দিয়ে মোট ১১৭ টি ট্রাম চালানো হতো। এই সময় থেকেই কলকাতায় ট্রাম পরিষেবা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে গতিপথ বাড়তে থাকে। কলকাতার বিভিন্ন পথে ট্রাম পরিষেবা শুরু হয়। এই সময় প্রায় ১৯ মাইল ট্রাম পরিষেবা চালু ছিল। ট্রামে চড়াকে আভিজাত্যের একটি অঙ্গ বানিয়ে দেয় ব্রিটিশ কোম্পানিটি।
কলকাতার ট্রামের আধুনিকীকরণের কাজ শুরু হয় ১৯০০ সাল নাগাদ। ১৯০২ সাল নাগাদ ঘোড়ায় টানা ট্রাম বন্ধ হলে সাহেবপাড়ায় প্রথম বারের জন্য বিদ্যুৎচালিত ট্রাম চলাচল শুরু হয়। কলকাতার ইতিহাস নিয়ে যারা চর্চা করেন তারা দাবি করেন ঘোড়ায় টানা ট্রাম আর বৈদ্যুতিক ট্রামের মাঝে খুব অল্প সময়ের জন্য কলকাতায় কলের ট্রাম চালু হয়েছিল। ১৮৮২ সাল নাগাদ চৌরঙ্গী ও খিদিরপুর যাত্রা পথে কিছুদিন এই কলের ট্রাম বা বাষ্প চালিত ট্রাম চলাচল করেছিল। জানা যায় ট্রাম কোম্পানি মানুষে টানা ট্রাম চালাবারও চেষ্টা করেছিল কলকাতায়।
ঘোড়ায় টানা ট্রাম কলকাতায় বন্ধ হলো কেন? এই নিয়ে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। অনেকে বলেন বিদ্যুতের ব্যবহার সহজ লভ্য হওয়া এর একটি কারণ। এছাড়াও পুরানো পত্রপত্রিকা ঘাঁটলে ঘোড়ায় টানা ট্রাম নিয়ে তৎকালীন পশু প্রেমীদের তরফে ক্ষোভ ছিল বলে জানতে পারা যায়। তবে শুধুমাত্র পশু প্রেমীদের ক্ষোভ নয়, গ্রীষ্মপ্রধান কলকাতার জলবায়ুর সঙ্গে বিদেশী ঘোড়াগুলির মানিয়ে নিতে পারার অক্ষমতাও ঘোড়ায় টানা ট্রাম বন্ধ হওয়ার কারণ বলে অনেকে মনে করেন।
১৯০০ সালের শুরুতে ৪ ফুট ৮.৫ ইঞ্চি মাপের স্ট্যান্ডার্ড গেজের ট্রাম লাইন চালু হয়। ১৯০২ সালে ট্রাম পরিষেবার বৈদ্যুতীকরণ শুরু হয়; যেটি ছিল এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবা। এই সময় থেকেই ট্রাম কলকাতার জনগণের অন্যতম বাহনে পরিণত হতে থাকে।
নিত্যযাত্রীদের ভিড়ের চাপ বাড়তে থাকে ট্রামগুলিতে। ১৯৪৩ সাল নাগাদ হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত ট্রাম লাইনের প্রসার ঘটানো হয়, ১৯ মাইল থেকে ট্রাম পরিষেবা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ মাইলের মতো।
সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকা ট্রামে কিন্তু শ্রেণী বিন্যাস ছিল স্পষ্ট। দুই কামরার ট্রামের প্রথম কামরাটি ছিল উচ্চবিত্ত শ্রেণীর জন্য আর দ্বিতীয় কামরাটি ছিল অপেক্ষাকৃত গরীবদের জন্য। ট্রামের দ্বিতীয় কামরাটি ছাত্র, অফিস যাত্রীদের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই সময়ের কলকাতায় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি চ্যাপলিনে সিনেমা বা স্টার থিয়েটার নাটক দেখতে ট্রামের প্রথম কামরায় চড়ে যেতে পছন্দ করতেন।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও বেশ কিছুদিন কলকাতায় ট্রাম পরিষেবা দিয়েছিল ব্রিটিশ কোম্পানি। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেটিকে আইন প্রণয়ন করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় পরিণত করেন। কিন্তু এর জন্য বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল বাংলার সরকারকে। তবে এর অনেক আগেই কলকাতার ট্রাম রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ১৯৫৩ সাল, ভারত স্বাধীন হলেও তখনও ব্রিটিশ কোম্পানি কলকাতায় ট্রামের পরিচালনা করছে। কোম্পানি ঠিক করে ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে এক পয়সা করে ভাড়া বৃদ্ধি করা হবে। তখন কমিউনিস্ট পার্টি অখণ্ড। সিপিআই সরাসরি জানিয়ে দেয় এই ভাড়া বৃদ্ধি তারা মানছে না। দরকারে তারা পথে নামবে। তারা আরও বলে ট্রাম কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাথে যোগসাজশে এই ভাড়া বৃদ্ধি করছে।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তখন চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায়। ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা প্রকাশ্যে আসলে আন্দোলন তীব্রতর হয়। ছাত্রযুব থেকে শ্রমিক শ্রেণী, মধ্যবিত্ত, পেশাজীবীরা এক এক করে আন্দোলন সামিল হতে থাকে।আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন জ্যোতি বসু, গণেশ ঘোষ, সুবোধ ব্যানার্জীর মতো বামপন্থী নেতারা।
অবরোধ, প্রতিবাদ, মিছিল, সমাবেশ, ১৪৪ ধারা, পুলিশের গুলিতে মৃত্যু-সব মিলিয়ে কেঁপে ওঠে কলকাতা। গোটা দেশের আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসে এই আন্দোলন। এই আন্দোলনের ফলেই ব্রিটিশ কোম্পানি সেই সময় বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল বর্ধিত ভাড়া।
সময়ের সাথে সাথে বদল হতে থাকে কলকাতার।রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এই বদল প্রবল ভাবে ছাপ ফেলে জীবনযাত্রায়। পরিবহণ ব্যবস্থায় আসতে থাকে নানা পরিবর্তন।
শহুরে জীবনের গতি ক্রমবর্ধমান। এই গতি বাড়াতেই ১৮৭৩ সালে কলকাতায় প্রথম চালু হয়েছিল ট্রাম। আর আজ সেই গতির দোহাই দিয়েই ট্রামকে বাতিলের তালিকায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। শহরের বিভিন্ন যাত্রাপথ থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে ট্রামের লাইন। তবে এর শুরু হয় ছয়ের দশকেই।
লক্ষ্য করলে দেখা যায় স্বাধীনতার আগে পরাধীন ভারতে ট্রাম পরিষেবা কলকাতা থেকে শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দিল্লি, মুম্বাই, নাসিক, করাচীর মতো শহরে। কিন্তু ছয়ের দশকে এসে দেখা গেল ট্রাম একমাত্র টিকে রয়েছে একমাত্র কলকাতায়। কিন্তু তখন থেকেই ট্রাম বাতিলের পরিকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল।
প্রফুল্ল চন্দ্র সেন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এই সময়েই হাওড়া থেকে প্রথমে ট্রাম তুলে দেন। যদিও জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আবার ট্রাম পরিষেবা বৃদ্ধি পেয়ে কলকাতার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে জোকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তৎকালীন সরকারের আমলেই একাধিক বার ট্রাম তুলে দেওয়ার প্রস্তাব আসতে থাকে।
রাজনৈতিক মহলের বরিষ্ঠদের মুখে ট্রাম নিয়ে তৎকালীন সরকারের অভ্যন্তরের কিছু গল্প আজও শোনা যায়। ১৯৮৬ সালে টালিগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রো চালু হবার পরেই টালিগঞ্জ এলাকার বাম নেতা তথা মন্ত্রী প্রশান্ত শূর টালিগঞ্জ থেকে ট্রাম তুলে দেবার বিষয়ে প্রস্তাব দেন। যদিও তৎকালীন সরকারের পরিবহণ মন্ত্রী রবীন মুখার্জি এর প্রবল বিরোধিতা করেন।
সুভাষ চক্রবর্তী পশ্চিমবঙ্গের পরিবহণ মন্ত্রী থাকাকালীন একবার শোনা গিয়েছিল টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর জমি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে। সেই সময় প্রতিবাদে নামেন বাংলার আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পৃথিবীর আধুনিক রাষ্ট্রগুলির দিকে যদি আমরা দেখি তাহলে দেখতে পাবো প্রবল ব্যস্ত শহরগুলির মধ্যে আজও ট্রাম চলাচল করে। সেটা বিশ্বে প্রথম ট্রাম চলা শহর লন্ডন হোক কিংবা জার্মানির বাণিজ্য নগরী ডুসেলড্রফ কিংবা নতুন করে ট্রাম চালু করা দুবাই, তাইওয়ান প্রভৃতি।
আমেরিকা, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া নতুন ভাবে ভাবছে অপেক্ষাকৃত দূষণ মুক্ত কম খরচের এই পরিবহণ চালু বা পরিষেবা বৃদ্ধি করার কথা। ইন্টারনেটে তথ্যতালাশ করে জানা যায় জার্মানিতে প্রায় ষাটটি, চিনে নয়টি, জাপানে ষোলোটি, আমেরিকায় পঁয়ত্রিশটি, ফ্রান্সে আঠাশটি, পোল্যান্ডে পনেরোটি, ব্রিটেনে দশটি অঞ্চল ছাড়াও বিশ্বের আরও কিছু শহরে ট্রাম পরিষেবা সেখানকার মানুষের অন্যতম পরিবহণ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
তবে কলকাতার ট্রাম শুধু বাঙালির জীবনের পরিবহণ মাত্র নয়, ঐতিহ্যের অঙ্গ। ট্রাম এই শহরের চলমান উত্তরলব্ধি। সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গ। শহরের ভালোবাসা, শহরের আবেগ। তারই প্রমাণ ১৯৮২ সাল নাগাদ বার্ণ স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানি একটি নতুন মডেলের ট্রামের নামকরণ করেন 'সুন্দরী'। বহুযুগ আগে তিনের দশকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপরাজিত উপন্যাসে উঠে আসে কলকাতার তখনকার বিস্ময় ট্রামের কথা।
অবশেষে আসি সেই দুর্ঘটনার কথায় যেটির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কলকাতার ট্রামের পথচলা। গড়িয়াহাটের কাছেই লেকমার্কেট। আজ যেখানে একটি শপিং মল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তার বিপরীতে, ট্রাম লাইনে শেষ শয্যা গ্রহণ করেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। এ এক বেদনার স্মৃতি, যা কলকাতার ট্রামের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।
আনন্দ, দুঃখ, বদলে যাওয়া শহরের ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও খুব অল্প কয়েকটি পথে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে কলকাতার ট্রাম। দরকার নতুন ভাবে যাত্রী পরিবহণ হিসেবে ট্রামকে বাঁচিয়ে তোলার। প্রশাসনের কর্তাদের নজর আদৌ ট্রামের দিকে পড়বে কিনা জানা নেই। তবে প্রায় দেড়শত বছর এই শহরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই বাহনটি যে কলকাতার কোহিনুর সে বিষয়ে কোন তর্কের অবকাশ থাকে না। ব্যস্ত শহরের গতিময়তা তাকে মনে না রাখলেও ইতিহাস বারবার মনে করিয়ে দেবে এই শহরের ভালবাসার অন্যতম পরিভাষা 'ট্রাম'-এর কথা, কলকাতার 'ট্রামকথা'।
প্রতিবেদন- অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়
Post a Comment