সচেতনতার অভাবে বিস্মৃতির পথে বাংলা ক্রীড়া ধারাভাষ্যের সুবর্ণ দিন
একটা সময় ছিল যখন "নমস্কার, ক্রিকেটের নন্দনকানন ইডেন উদ্যান থেকে অজয় বসু বলছি" শুনলে বাঙালির মধ্যে শিহরণ জাগতো। খেলায় ধারাবিবরণীর যে কতটা পেশাদারিত্ব রাখা যায় তা প্রমাণ করেছিলেন অজয় বসু, পুষ্পেন সরকার, কমল ভট্টাচার্য, সুকুমার সমাজপতি, কার্তিক বসু ও রথিন মিত্রের মতো ধারাভাষ্যকাররা।
পঞ্চাশের দশকে অজয় বসু, পুষ্পেন সরকারদের রেডিওর ধারাবিবরণী মানুষকে যেন ফুটবল মঞ্চে পৌঁছে দিত। মাঝে মাঝে রাজেন সেন, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মতো মানুষও খেলায় ধারাভাষ্য রাখার জন্য আসতেন। আগে থেকেই ঘোষণা করা থাকত কে ধারাভাষ্যকার থাকবেন। অজয় বসুর উল্টো দিকে পুষ্পেন সরকার থাকছেন শুনলে মাঠ ভর্তি হয়ে যেত। বাংলা ধারাভাষ্য ছাড়া খেলা দেখার কথা ভাবতেই পারত না বাঙালি সমাজ।
ধারাভাষ্যকার কার্তিক বসুর বেফাঁস মন্তব্যও মাঝে মাঝে হয়ে উঠত আলোচনার বস্তু। একবার তো কার্তিক বসু বলেই ফেললেন- "শালা কালিচরণ কে আউট না করলে ভারতের কোনো আশা নেই।" যা নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল গোটা বাংলায়।
ক্রিকেটে ধারাভাষ্য দিতেন কমল ভট্টাচার্যের মতো মানুষ। পি.কে. ব্যানার্জীও মাঝে মাঝে ধারাবিবরণী রাখতেন। অজয় বসু, পুষ্পেন সরকারের পরের দিকে সেই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সুকুমার সমাজপতি, কার্তিক বসু, রথীন মিত্র, প্রেমাংশু চ্যাটার্জীর মতো মানুষ।
তখনকার সময়ে বিভিন্ন পাড়া, গ্রাম, শহরের মাঠের বাংলা ধারাভাষ্য আলোড়ন তুলত। দুঃখের বিষয় বর্তমানে বাঙালি এতটাই হীনমন্য যে বিজাতীয় ভাষায় ধারাভাষ্য করতে হচ্ছে আজ তাকে। দু-একজনকে সামাজিক মাধ্যমে বলতেও শুনলাম বাংলা ধারাভাষ্যে নাকি পেশাদারিত্ব নেই, তাই অন্য ভাষায় ধারাভাষ্য শুনি। এরা যদি তখনের 'আবার একটা দুর্দান্ত গো-ও-ও-ও-ল' শুনতো তাহলে এ ধারণা পাল্টে যেত। ইউরো কাপের মতো খেলাতেও বাংলা ধারাভাষ্য শোনার সুযোগ রাখা হচ্ছেনা। বিভিন্ন চ্যানেলে ডিফল্ট হিসেবে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যার ফলে বাঙালির মধ্যে তৈরি হচ্ছে হীনমন্যতা। বাংলা ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজও পাচ্ছেন না বাঙালি। এভাবেই বাংলা ভাষাকে গুরুত্বহীন করে তোলা হচ্ছে।
ছবিতে ধারাভাষ্যকার সুকুমার সমাজপতি |
সমস্ত ক্রীড়াপ্রেমী বাঙালির প্রতি অনুরোধ বিভিন্ন চ্যানেল, সামাজিক মাধ্যমে বাংলা ধারাভাষ্যের জন্য আওয়াজ তুলুন, টুইট করুন, চিঠি দিন যাতে সেই সুদিন আবার ফিরিয়ে আনা যায়। যে সমস্ত ক্রীড়া-ব্যক্তিত্ব আজ খেলার সাথে যুক্ত তাদের অবসর সময়ে রেফারি, নির্বাচক, ধারাভাষ্যকারের মতো কাজগুলো গুরুত্বপূর্ণ; অতএব খেলায় সুযোগের পাশাপাশি এই সব দিকগুলিও বাঙালি সমাজের চিন্তা করা প্রয়োজন। ধারাভাষ্যকারদের অটোগ্রাফ নিতে দৌড়ে চলা বাঙালির এই হীনমন্যতা কখনোই কাম্য নয়।
প্রতিবেদন- অমিত দে
Post a Comment