বরাকে ঘটে যাওয়া বাঙালির বিস্মৃত ভাষা দিবস ২১শে জুলাই
বাংলা ভাষার জন্য বাঙালিকে আজীবন লড়াই করতে হয়। বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির লড়াই যেন থামবার নয়। এখনও সবকিছুতে বঞ্চিত আমাদের মায়ের ভাষা। আজও বাংলা ভাষার জন্য বাঙালিকে প্রাণ দিতে হচ্ছে। বাঙালি আজকে ভুলে গেছে বরাক উপত্যকায় ১৯৮৬ সালের ২১শে জুলাই আরেকটি ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। যেখানে শহীদ হন দুই বীর বাঙালি ভাষাযোদ্ধা।
বাঙালির ইতিহাসে ২১শে জুলাই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অন্তরালে চাপা পড়ে গেছে ১৯শে মে ও ২১শে জুলাই এই বিশেষ দুটো দিনের কথা। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পাই ২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯শে মে ও ২১শে জুলাই এই তিনটি দিনই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮৬ সালের ২১শে জুলাই বরাক উপত্যকার অর্ধশতাব্দী প্রাচীন এক বহমান ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় দিন।
কাছাড়, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জের তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত বরাক উপত্যকা কৌশলগত ভাবে অবস্থিত ভারতের আসামের দক্ষিণতম অংশে। তবে এর কৌশলগত অবস্থান সত্ত্বেও, বরাক উপত্যকা গঠিত হওয়ার পর থেকেই আর্থসামাজিক ও অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে অনুন্নত থেকে যায়। রাজ্য সরকার উদাসীন ছিল বলেই এখনও পর্যন্ত উপত্যকার উন্নয়নের বিষয়টি উদ্বিগ্ন ছিল। সরকারের এই মনোভাব উপত্যকার দিকে সাধারণভাবে জনগণকে ক্ষুব্ধ করে। এর ফলে বহু বছর ধরে এখানকার বাঙালিরা বাংলা ভাষা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
বরাক উপত্যকার বীর বাঙালিদের লড়াই এ প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়ের অজান্তে চাপা পড়ে যাচ্ছে। বাঙালি অধ্যুষিত কোনো জায়গা থেকেই ভাষা শহীদদের অবদান নিয়ে চর্চার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। বাঙালির রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস মুছে ফেলারও গভীর চক্রান্ত চলছে চারদিকে। কিন্তু সত্য কখনো চাপা থাকে না। মিথ্যের গাঁদায় সত্যের সূচ একদিন না একদিন ফুটবেই।
১৯৮৬ সালের ২১শে জুলাই করিমগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ঝরে পড়লো তরতাজা দুই যুবকের প্রাণ। গোটা করিমগঞ্জ জুড়ে শুরু হলো থমথমে পরিস্থিতি৷ দুই মৃত যুবকের নাম জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাস। ভাষা রক্ষার অধিকারের আন্দোলন চলাকালীন সফররত তৎকালীন আসামের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লকুমার মহন্তের বিরুদ্ধে করিমগঞ্জে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের গুলি চালনায় দুটি তরুণ প্রাণ দিব্যেন্দু দাস ওরফে যিশু ও জগন্ময় দেব ওরফে জগন অকালে নিভে যায়। বরাক উপত্যকার মানুষের কাছে এই দিনটি তাই মাতৃভাষার অধিকার রক্ষা আর সেই সঙ্গে এই উপত্যকার মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ প্রতিহত করার সংকল্পে নতুন করে অঙ্গীকার গ্রহণের তাৎপর্য বয়ে আনে।
২১শে জুলাই দিনটির মধ্য দিয়ে করিমগঞ্জে আরেকটি ভাষা দিবসের উন্মেষ ঘটে। বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষায় বারবার আন্দোলন ও প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বরাক উপত্যকা ভাষা আন্দোলনের পীঠস্থান হয়ে উঠেছে। শুধু বাংলা ভাষার জন্য নয়, মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে এখানে মণিপুরি সুদেষ্ণাকেও প্রাণ দিতে হয়েছে। চলতি বছরে পঁয়ত্রিশ তম বছরে পদার্পণ করলো এই ভাষা শহীদ দিবস। যে দিনটির গুরুত্ব প্রত্যেক বাঙালির বোঝা উচিৎ।
তথ্যসূত্র- সাময়িক প্রসঙ্গ, ডঃ স্বরূপা ভট্টাচার্যের জার্নাল
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment