'বিশ্বকোষ লেন' বইয়ের নামে আস্ত একটি রাজপথ
বাংলার বইয়ের নামে একটা আস্ত রাস্তা আছে কলকাতার বুকে। 'বিশ্বকোষ লেন' জায়গাটার কথা তো সকলেই জানেন। যে লেনের পূর্ববর্তী নাম ছিল 'কাঁটাপুকুর বই লেন'। ভারতবর্ষের আর কোনো শহরের রাজপথের নাম কোনো বইয়ের নামে হয়েছে কিনা জানা নেই। প্রায় ১৭ হাজার পৃষ্ঠার মোট ২২ খণ্ডের সংকলন। নাম 'বিশ্বকোষ', যা গোটা ভারতের প্রথম এনসাইক্লোপিডিয়ার বই। আর সেই বইয়ের নামেই আস্ত রাজপথ, বিশ্বকোষ লেন। এই রাস্তাটি তৈরি হয়েছিল ১৮৮৮-৮৯ খ্রিস্টাব্দে।
লেখক নগেন্দ্রনাথ বসু মাত্র ১৮ বছর বয়সে 'শব্দেন্দু মহাকোষ' নামে ইংরেজি থেকে বাংলা অভিধানের সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন৷ কিন্তু তাঁর অবিস্মরণীয় কৃতিত্ব হলো বাংলা বিশ্বকোষের সম্পাদনা যা প্রথম বাংলা এনসাক্লোপিডিয়া। এর কাজ শুরু করেন রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায় ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ সালে। ১৮৮৮ সালে নগেন্দ্রনাথ বসু ২২ বছর বয়সে এই বিশ্বকোষের কাজ শুরু করেন। এরপর ২২ বছর কঠোর পরিশ্রম করে তিনি প্রকাশ করেন বাংলা বিশ্বকোষের ২২ টি খণ্ড।
শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় থেকে ভূপেন বোস অ্যাভিনিউ ধরে খানিকটা এগোলে মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজ। তারপর শান্তি ঘোষ স্ট্রিট। সেই রাস্তা দিয়ে ঢুকে বাগবাজার চিলড্রেনস পার্ককে বাঁ হাতে রেখে সামান্য এগোলেই বিশ্বকোষ লেনে পৌঁছে যাওয়া যায়। আবার অন্য পথে বাগবাজার স্ট্রিট ধরে এগিয়ে শচীন মিত্র লেন থেকে সামান্য এগোলেও বিশ্বকোষ লেনে পৌঁছানো সম্ভব।
নগেন্দ্রনাথ বসুর জন্ম ১৮৬৬ সালের ৬ ই জুলাই। তাঁর পূর্বপুরুষরা হুগলির মাহেশ থেকে এসে থিতু হন এই বাগবাজারেই। শৈশবকাল থেকেই অসম্ভব মেধাবী ছিলেন তিনি৷ নগেন্দ্রনাথ বসু একাধারে লেখক এবং অন্যধারে ছিলেন একজন খ্যাতনাম প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিক। ওনার লেখা অমূল্য প্রাচীন পুঁথি ও পাণ্ডুলিপির সংগ্রহের ভিত্তিতেই ১৯১৯ সালে শুরু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ।
১৯১১ সালে ২২ খণ্ডে প্রকাশিত হয় নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত বিশ্বকোষ। এরপর দীর্ঘ ২০ বছর পর আবারও তিনি বিশ্বকোষের কাজ আরম্ভ করেন। যদিও সেই কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাঁর জীবন গাড়ি তাঁকে থামিয়ে দেয়। মৃত্যুর দূত নিভিয়ে দেয় তাঁর জীবন শিখা। জীবন থেমে গেলেও ইতিহাস তাঁকে মনে রাখলো বিশ্বকোষের মতো অবিস্মরণীয় সৃষ্টির জন্য। কারণ এই বিশ্বকোষই ঘরে বসে পৃথিবীকে জানার সুযোগ করে দিয়েছিল বাঙালিকে৷ ১৯১৫ সালে কলকাতা কর্পোরেশন তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তার নাম বদলে রাখে 'বিশ্বকোষ লেন'। বইয়ের নামে রাস্তার নাম রাখার ঘটনা ইতিহাসে সেই প্রথমবারই ঘটলো৷ যে ঘটনা বাঙালির কাছে গর্বের।
এমনিতেই কলকাতা মানেই বইয়ের শহর। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট বাংলা বইয়ের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। প্রতি বছর এই শহরেই অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বইমেলা। বই বিক্রির নিরিখে একে বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলাও বলা যায়। ভারতের সবচেয়ে বড়ো বইয়ের লাইব্রেরি 'ন্যাশনাল লাইব্রেরি'ও রয়েছে কলকাতায়। অতএব বই দিয়ে যে শহরকে চেনা যায় সেই শহরে বইয়ের নামে রাস্তার নাম অবশ্য ততটা অবাক করেনা বাঙালি সমাজকে।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment