১৭৫ বছর পেরিয়ে গেলেও মিষ্টির স্বাদ বদলায়নি ফেলু মোদকের
বাঙালির মিষ্টি প্রেম নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। মিষ্টি শুধু বাঙালির প্রিয় খাদ্যই নয়, বাংলার, শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি, উৎসব মিষ্টি ছাড়া কল্পনা করা যায় না। বাংলার সমাজ জীবনকে খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় মিষ্টি কি ভাবে বাংলার জনজীবনে প্রভাব বিস্তার করে আছে। উৎসব থেকে কৃচ্ছ সাধন, উপাসনা থেকে উৎযাপন, জন্ম থেকে বিসর্জন বাঙালির জীবনে প্রতিটি পরতে রয়েছে মিষ্টির ব্যবহার।
অনতিদূরের ইতিহাস স্মরণ করলে আমরা পৌঁছে যেতে পারি এক মিষ্টি নিয়ে ঘটা অদ্ভুত ঘটনায়। জানা যায় ১৯৬৭ সালে একবার পশ্চিমবঙ্গে দুধের সংকট দেখা দিয়েছিল। শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থদের জন্য দুধ অতি প্রয়োজনীয়। সরকার দুধের সংকটের কারণ খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন এক বিচিত্র তথ্য। জানা গেলো মিষ্টি তৈরির বাড়বাড়ন্তের জন্যেই নাকি দুধের সংকট আরও তীব্র হচ্ছে।
মিষ্টি তৈরি যখন হচ্ছে তখন ভোগও হচ্ছে। অতএব কোপ পড়ল রসগোল্লা সন্দেশের উপর। সেই আঘাতের গভীর অভিঘাতে, বাঙালি রীতিমতো প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল!
যদিও জিলিপি, গজা, লাড্ডু, দরবেশ জাতীয় মিষ্টি উৎপাদন চালু ছিল কিন্তু রসগোল্লা, সন্দেশের অভাবে কবি উপেন্দ্রনাথ মল্লিক লিখেছিলেন-"সন্দেশ কাঁদিয়া কহে রসগোল্লা ভাই/দেশ ছেড়ে চল মোরা ভিন্ন দেশে যাই/এই রাজ্যে শুনি নাকি দুধের দরকার/আমাদের দূর তাই করিল সরকার"।
মিষ্টির সঙ্গে বাঙালির যে নাড়ির যোগ তার প্রমাণ আছে চর্যাপদের পঙক্তিতেও। সেখানে বলা হয়েছে, 'ওগগরা ভতা গাইক ভিত্তা'- অর্থাৎ ঘি, দুধ দিয়ে তৈরি পরমান্ন। যা সরাসরি মিষ্টি না হলেও বাংলার আজকের মিষ্টির পূর্বসূরি, সে কথা অস্বীকার করা যায় না।
ইতিহাসের কথাই যখন উঠলো তখন সেই সরণী ধরে আরও কিছুটা এগিয়ে যাওয়া যাক। এই রাস্তার ধারে মাইল স্টোনের মতো দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন নাম। যাদের হাতে তৈরি মিষ্টি বাঙালির রসনার স্মারক হিসেবে অমর অক্ষয় হয়ে আছে।
এমনই একজন ফেলু মোদক। যিনি একদিকে ময়রা, অন্যদিকে শিল্পী আবার আরেকদিকে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যবসায়ী। হুগলীর রিষড়া অঞ্চলে আজও ফেলু মোদকের দোকানটি নিজের ঐতিহ্য বজায় রেখে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে ঐতিহাসিক মিষ্টি নির্মাণ পদ্ধতির সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং।
ফেলু মোদক এর যাত্রা শুরু হয় আজ থেকে প্রায় ১৭৫ বছর আগে। মোদক, অর্থ ময়রা। ফেলু চরণ মহাশয়ের আসল পদবি ছিল 'দে'। বাবা কার্তিক চরণ দে নিজেও ছিলেন একজন মিষ্টির কারিগর। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই ফেলু মোদক মিষ্টি ব্যবসায় আসেন। প্রথম জীবন থেকেই মিষ্টি তৈরিতে হাত হাতযশ ছড়িয়ে পড়ে রিষড়া ছাড়িয়ে কলকাতাতেও। সেই সময় কলকাতার বাবুরা নতুন ধরণের মিষ্টি তৈরিতে রীতিমতো উৎসাহ প্রদান করতেন। ময়রাদের মধ্যেও নতুন মিষ্টি সৃষ্টি করার একটা চল ছিল।
ফেলু মোদক বিষড়াতে নিজের নামেই একটি মিষ্টির দোকান খুলে বসেন। ধীরে ধীরে দোকানের নাম ছড়িয়ে পরে মিষ্টি প্রেমীদের দুনিয়ায়। স্বনামধন্য হয়ে ওঠেন ফেলু মোদক। নিত্যনতুন মিষ্টি আবিষ্কারের তৎকালীন প্রবণতার কথা আগেই বলেছি। যে তথ্য জানা যায় লবঙ্গ লতিকা বলে যে মিষ্টিটি আজও মিষ্টি রসিকদের মুখে মুখে ফেরে সেই লবঙ্গ লতিকার আবিষ্কারক স্বয়ং ফেলু মোদক। শোনা যায় চিনি, ঘি, এলাচ, দারুচিনি, ময়দা, খোয়া ক্ষীর এবং সর্বোপরি একটি লবঙ্গ দিয়ে তৈরি এই মিষ্টির ধারনাটি ফেলু মোদক পেয়েছিলেন ব্রিটিশদের রসুই থেকে। তবে তার সঙ্গে মিশিয়েছিলেন তার সৃষ্টিশীলতা।
আজ পাঁচ প্রজন্ম ধরে চলছে ফেলু মোদকের দোকান। এই দোকানের মিষ্টি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে সমাদৃত হয়েছে অনেক আগেই। বর্তমানে সম্পূর্ণ যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি করা হয় বেশিরভাগ মিষ্টি। তবে স্বাদে সামান্যতম আপোষ করেননি এই প্রজন্মের প্রতিনিধিরা। যুগ যুগ ধরে বাঙালির ভালোবাসার রসনাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। বিশ্বাস, যুগ যুগ ধরে প্রবাহিত হয়ে আসা ঐতিহ্যের রসনা বাঙালির ঘরে ঘরে এই ভাবেই পৌঁছে দিতে থাকবেন ফেলু মোদকের উত্তরসূরিরা।
প্রতিবেদন- অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়
Post a Comment