Header Ads

হায় বাঙালি হায় : তোমার জাত গিয়েছে


আচ্ছা, ধরুন অনেকে তোড়জোড় করে কাশ্মীর বেড়াতে গিয়ে আপনি জানতে পারলেন - কাশ্মীরে এখন আর ডাল লেক নেই; হাউসবোট নেই, শিকারা নেই - এরকম আরো অনেক কিছুই নেই। বা ধরুন রাজস্থানের জয়সলমীরে আর উট পাওয়া যায় না, সেখানে রাজস্থানি পোশাক পরিহিত মাথায় বিশাল পাগড়ী ওয়ালা বাজনদারের বাজনার সহযোগে রাজস্থানী ঘাগড়া এবং অসংখ্য অদ্ভুত গয়না পরা মহিলাদের নাচ আর দেখতে পাওয়া যায় না, এমনকি হাওয়া মহলটিও বেমালুম হাওয়া হয়ে গেছে! কেমন লাগবে বলুন তো আপনার? বা ধরুন হরিদ্বারে গিয়ে দেখতে পেলেন, গঙ্গা আর সে গঙ্গা নেই; লছমনঝুলার জায়গায় এখন ছয় লেন কংক্রিটের সেতু; আগ্রায় গিয়ে দেখতে পেলেন তাজমহলটা আর সাদা নেই, কেউ সেটা কিনে নিয়ে নিজের ইচ্ছামতো বেগুনি নীল হলুদ রং লাগিয়েছে; আর সেখানে আপনাকে ঢুকতে দিচ্ছে না মোটা গোঁফওয়ালা এক বিচিত্র 'পেহেরেদার', লাঠিপেটা করে সবাইকে হঠিয়ে দিচ্ছে! কেমন লাগবে সেদিন?


না, আমরা কেউই কোনো দিন এই উদাহরণগুলির বাস্তবায়ন আশা করি না; আমরা কাশ্মীর রাজস্থান আগ্রা হরিদ্বার সব তাদের মতো করেই চাই। তাইতো?

যদি তাই হবে, তাহলে আমরা নিজের ঘরের দিকে কেন ফিরে তাকাচ্ছি না? ভাবুন তো, আমাদের সাধের বাংলায় যদি আর 'রসগোল্লা' না পাওয়া যায়? (এখনি অনেক অতীতচারি বলে থাকেন তাদের সময়ের রসগোল্লা আর নেই।) বা জনাইয়ের 'মনোহরা', বহরমপুরের 'ছানাবড়া', কৃষ্ণনগরের 'সরভাজা' বা 'সরপুরিয়া' - এসব যদি হারিয়ে যায়? 

বা ধরুন বাঙালি বিয়েতে (হিন্দু মুসলিম সহ বাংলার সকল সম্প্রদায়ের কথাই বলছি) নিজ লোকাচার, আচার বদলে হলদী, মেহেন্দী, সংগীত, বিদাই এসব এসে আবহমান ধারাগুলি যদি হঠাৎ উৎপাটন করে? (থুড়ি, ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে! এই ধারা চলতে থাকে ভবিষ্যতে বাঙালি বিয়ে দেখতে গিয়ে হয়তো আপনি নিখাদ উত্তর ভারতীয় বিয়ে দেখে আসবেন।) একটু ভেবে বলুন, জাতি হিসেবে তা কি বাঙালির উত্তরণ? না অবনমন?

যদি পোশাকের কথাই আসি, বাঙালি পুরুষ ধুতি-পাঞ্জাবি বহু পূর্বেই ছেড়ে দিয়েছে; কিন্তু মহিলারা এখনো যতটা সম্ভব শাড়ির লিগেসি বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু বর্তমানে যে কোন আনন্দ অনুষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে শাড়ি ধুতি-পাঞ্জাবি পাজামা এসবের এক অদ্ভুত অবাঙালিকরণ ঘটে গেছে। তা সে পোশাকের মেটেরিয়ালের ক্ষেত্রেই বলুন, রং ও ডিজাইনের ক্ষেত্রেই বলুন, বা পরিধান ভঙ্গিমার দিকেই আপনি তাকান; তা যেন ঠিক বাঙালি আর থাকছে না। এবং এটাই ট্রেন্ড, এটাই কুল। ঠিক আছে তো?

আমরা যদি চীন-জাপান আমেরিকা জার্মানি গ্রীস - যে কোন দেশের দিকে তাকাই, দেখতে পাবো উৎসবে অনুষ্ঠানে তারা তাদের জাতীয় ঐতিহ্যকে বুক দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ব্রাজিলের সাম্বা বলুন, বা আমেরিকার হ্যালোউইন, বা চিনা ও জাপানি নববর্ষ - জাতীয় পোশাক জাতীয় বাদ্যযন্ত্র - এর বাইরে তারা কথা বলেন না। অথচ আমরা যদি নিজেদের দিকে তাকাই, কি দেখতে পাবো? ঘর থেকে আমরা ক্রমাগত বাইরের দিকেই আগ্রহ বেশি দেখিয়েছি। 

উৎসব অনুষ্ঠান মানেই কন্টিনেন্টাল চাইনিজ বা মোগলাই; যেন বাঙালি এতদিন শুধু ঘাস খেয়ে থাকতো!

বাঙালি চিরকালই আন্তর্জাতিক। ৪০০০ বছর আগে জাতির উদ্ভব কাল থেকেই বাঙালি একটি মিশ্র / সংকর জাতি। এবং তা হীনমন্যতার নয়, বরং শ্লাঘার। এই সংকরায়ণের ফলে বাঙালির মধ্যে আদান-প্রদানের উদারতা জন্মগত। বাঙালি পোস্ত, পিজ্জা পাস্তা পান্তা সবই একা হাতে ম্যানেজ করার ক্ষমতা রাখে। ডাল থেকে 'দাল বাটি চুর্মা', সন্দেশ থেকে 'বেসনের লাড্ডু' কোন কিছুতেই তার আপত্তি নেই। নিজের রন্ধন ঐতিহ্য অভূতপূর্ব অতুলনীয় হওয়ার কারণে কোন দিন অন্যের রন্ধনপ্রণালী আয়ত্ত করতে তার মধ্যে কোন হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়নি। যদি আমরা বাঙালির 'পিঠা'র দিকে তাকাই; বা 'মিষ্টান্ন' - হয়তো হাজার খানেক পদ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে। যদিও মৌলিক জায়গাটা সেই সেদ্ধ ভাপা ভাজা। কিন্তু উপকরণের অদল বদল ঘটিয়ে স্বাদে গন্ধে দর্শনে অতুলনীয় খাদ্য প্রস্তুতি পৃথিবীর আর কোন জাতির মধ্যে পাওয়া যাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।  

অথচ যদি এ যুগের দিকে তাকাই, কি দেখব? আমাদের সেই অতুলনীয় পিঠা ভান্ডার ক্রমশ নিঃশেষিত। শুধুমাত্র পরিশ্রম বিমুখ হয়ে ওঠার কারণে এবং ছদ্ম উন্নাসিকতার কারণে সৃষ্ট হীনমন্যতার জন্য আমরা আমাদের ঐতিহ্য হারাচ্ছি; শুধু তাইই নয়, পরিচিতিও হারিয়ে ফেলছি। কারণ বাঙালির পরিচিতি এই সবকিছুর মধ্যেই নিহিত রয়েছে।

এবার বলুন বাঙালির যদি 'বাংলা' ভাষা না থাকে; খাবারে ভাজাভুজি, বড়া, শাক ডাল তরকারি, বিভিন্ন মাছ মাংসের পদ, রকমারি চাটনি, মিষ্টি, পিঠে-পুলি - এসব বাঙালিয়ানা না থাকে; যদি ধুতি শাড়ি পাঞ্জাবি পায়জামার সৌখিন বাবুয়ানি না থাকে; বাংলার বিশ্ববন্দিত আড্ডা তর্ক না থাকে; গান কবিতা নাটক নাচ - এসব 'কালচার ফালচার' না থাকে; আর‌ও যা কিছু বাঙালিকে বাঙালি বলে পরিচিত করে তা না থাকে, তবে বাঙালি বাঙালি থাকে কি?

আজ সত্যিই বাঙালি সব হারাচ্ছে। পয়লা বৈশাখে উৎসব নেই, জন্মদিনের পায়েস নেই, প্রবাদপ্রতিম আতিথেয়তা নেই, পারিবারিক বন্ধন নেই, খুনসুটি সিনেমা আড্ডা নেই, নির্ভেজাল পৌষল্লা নেই; আমাদের নদী জল মাঠ জঙ্গল গ্রাম জনপদ বদলে গেছে, আমাদের মহানগর বদলে গেছে, আমাদের আকাশ রেখা বদলে গেছে, এমনকি দিন দিন আমাদের চেহারাও বদলে যাচ্ছে; অতীতের বাঙালির সাথে বর্তমান বাঙালির মিল খুঁজে পাওয়া বড়ই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। হায় বাঙালি হায় আসলেই তোমার জাত গিয়েছে।

প্রতিবেদন- অরিন্দম চন্দ্র 


2 comments:

  1. লিটারেসি প্যারাডাইসকে ধন্যবাদ জানাই আন্তরিক।

    এই বিষয়ে সকলের মতামত চাই। বাঙালি তার সকল বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য নিয়ে আধুনিকতার পথে এগিয়ে চলুক। জয় বাংলা।

    ReplyDelete
  2. সত্যি বাঙালিয়ানা কে হারিয়ে ফেলছি।
    বাংলা ধারাবাহিক গুলো তে যখন হিন্দী গান শোনা যায় তখন বিরক্ত লাগে। আবার রথযাত্রার দিন পাড়ার মোড়ে পাঁপড় ভাজা র জিলিপি কিনতে লোকজনের ভিড় দেখলে আনন্দ ও লাগে।

    ReplyDelete